মহিউদ্দিন আল আজাদ॥
মহান মুক্তিযদ্ধের ১নং সেক্টর কমান্ডার, চাঁদপুরের কৃতি সন্তান মেজর অবঃ রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার নাওড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা (মরহুম) আশরাফ উল্লাহ ঢাকা জেলার ডিষ্ট্রিক্ট এ্যাডুকেশন অফিসার ছিলেন। তিন ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে রফিকুল ইসলাম পিতা মাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান।
তাঁর স্ত্রী চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কন্যা। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে।
রফিকুল ইসলাম নিজ গ্রামের নাওড়া স্কুল, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায়, গোপালগঞ্জ মডেল স্কুল, শরিয়তপুরে পালং, কুমিল্লার চান্দিনা ও ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় লেখাপড়া করেন এবং ১৯৫১ সালে ব্রাহ্মনবাড়িয়া অন্নদা মডেল হাই স্কুল হতে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ হতে আইএসসি পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স পড়াশুনা করেন।
১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ‘ইউপিপি’ সংবাদ সংস্থায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান আর্মিতে যোগ দেন এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান আর্মির ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁকে আর্টিলারী কোরে নেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে তিনি লাহোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাঁর ইউনিট ২৪ ফিল্ড রেজিমেন্ট (আর্টিলারী) সহ যশোহর ক্যান্টনমেন্ট আসেন এবং রেজিমেন্টের এ্যাডকুট্যান্ট-এর দায়িত্ব পালন করেন। পরে ডেপুটেশনে দিনাজপুরে ৮ উইং ইপিআর-এর এ্যাসিস্ট্যান্স উইং কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭০ সালের প্রথম দিকে তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর চট্টগ্রামস্থ হেডকোয়ার্টারে এ্যাডজুট্যান্ট পদে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ৮:৪০ মিনিটে তিনি তাঁর অধীনস্থ ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিক ও জেসিওদের নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং রাত ১১:৩০ মিনিটে সমগ্র চট্টগ্রাম শহর দখলে আনতে সক্ষম হন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। ৫টি সাব-সেক্টর নিয়ে গঠিত ১নং সেক্টরটি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার অংশ নিয়ে গঠিত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্যে আরো অনেকের সাথে তাঁকে জীবিত ব্যক্তিবর্গের সর্বোচ্চ সম্মান ‘বীরউত্তম’ এ ভূষিত করা হয়।
১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর কিছুকাল তিনি চট্টগ্রামে সে সময়কার বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘দি পিপলস ভিউ’-র সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭৭ সালে তিনি ঢাকা ওয়াসার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং ১৯৮১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
পরবর্তীতে তিনি হ্যান্ডলুম বোর্ড এর চেয়ারম্যান এবং তারপরে বি.আই.ডব্লিউ.টি.সি’ র চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের প্রথম নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়-এই দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৯১ সালে চাকুরি থেকে অবসর নেন।
১৯৯৬ সালে তিনি চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি নির্বাচনী এলাকা ২৬৪-চাঁদপুর-৫ হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ঐ বছরের ২৩ জুন হতে ১৯৯৯ সালের ১১ মার্চ পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮১ সালে তিনি ‘ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট’-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘হাভার্ড বিজনেস স্কুলে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে অধ্যয়ন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তাঁর রচিত ‘এ টেল অব মিলিয়নস’ বইটি ১৯৭৪ সালে এবং বইটির বাংলা অনুবাদ ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার করুণ ও বেদনাময় কাহিনী নিয়ে রচিত তাঁর আরেকটি বই ‘মুক্তির সোপানতলে’ প্রকাশিত হয় ২০০১ সালের জুলাই মাসে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পুনরায় চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি নির্বাচনী এলাকা-২৬৪ চাঁদপুর হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে তিনি পুনরায় চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি নির্বাচনী এলাকা-২৬৪ চাঁদপুর হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
পরবর্তীতে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি ৪র্থবারের মতো চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বর্তমানে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নৌ-পরিবহন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলায় জনপ্রিয়তায় শীর্ষ একজন নেতা মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীরউত্ত। তৃণমুল সাধারন মানুষের কাছে সৎ ও ভালো মানুষ হিসেবে তিনি পরিচিত।
তাঁর সময়ে হাজীগঞ্জ শাহরাস্তি উপজেলার ব্যাপক উন্নয়ণ ঘটেছে। তিনি শুধু মাত্র ডাকাতিয়া নদীর উপরই ৭টি সেতু নির্মাণ করেছেন। আরো ২টি সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১, ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত হাজীগঞ্জ শাহরাস্তিতে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণ করেছেন। প্রায় ৭০০ এর মতো ব্রীজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে , ৮’র মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ১০০’র উপরে ইউনিয়ন উপ -স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তমই হাজীগঞ্জ পৌরসভাকে ‘খ’ শ্রেণি থেকে ‘ক’ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করেন এবং শাহরাস্তি পৌরসভাকেও ‘গ’ থেকে ‘খ’ এবং ‘খ’ থেকে ‘ক’ -তে উন্নীত করেন।
তিনি হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি উপজেলায় ধান উৎপাদনের জন্য সাড়ে ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন খাল খনন করেছেন।
হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তিতে মডেল প্রজক্টের আওতায় ২টি মডেল ৩টি অত্যাধুনিক মডেল ভবন করা হয়েছে। যার একটি মেহের উচ্চ বিদ্যালয়ে ও অপরটি হাজীগঞ্জ পাইলট হাই স্কুল এন্ড কলেজে। তার আমলেই গ্রামীণ সড়কের ব্যাপক উন্নয়ণ হয়েছে। বেলচোঁ-রামচন্দ্রপুর-শমেসপুর ফেরিঘাট পর্যন্ত ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭ হাজার ৮শ ৪৫ মিটার পাকা সড়ক নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এ ছাড়াও গ্রামীণ সড়কের ব্যাপক পাকাকরণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। ৭ থেকে ৮শ ব্রীজ কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ৮’শ স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা ভবন পাকা করণ করা হয়েছে।
হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলাকে শতভাগ বিদ্যুতায়ণ, গৃহহীণ মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। দু’ উপজেলায় ২টি করে ৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানত জাতীয় করণ এবং একটি করে মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।
হাজীগঞ্জ বাজারের ব্যবাসয়ীদের স্বার্থ বিবেচনা করে ডাকাতিয়া সেতুর টোল প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে হাজীগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। এ ছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলের সাথে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ উন্নত হয়েছে।
তিনি হাজীগঞ্জ বাজারকে যানজট মুক্ত করার লক্ষে হাজীগঞ্জে একটি বাইপাস সড়ক নির্মাণের চেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে ইতিমধ্যে সমীক্ষা শেষ হয়েছে। সমীক্ষার কাজ সেতু বিভাগেও প্রেরণ করা হয়েছে। যাছাই-বাছাই শেষে বাইপাস সড়ক নির্মাণ কাজ শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে।
মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম এমপি শাহরাস্তিতে প্রায় ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ওয়াকওয়ে নির্মাণ করেছেন। তিনি আবারো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে হাজীগঞ্জে একটি ওয়াকওয়ে নির্মাণ করবেন বলে জানিয়েছেন।
চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি) আসনে মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম এমপির ২০ বছর সময়ে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন মূলক কাজ করা হয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক- মহিউদ্দিন আল আজাদ, ই-মেইল: trenadinews@gmail.com, মোবাইল-০১৭১৭-৯৯২০০৯
Copyright © 2024 সাপ্তাহিক ত্রিনদী. All rights reserved.