অনলাইন নিউজ ডেস্ক :
অনেকটা হঠাৎ বাড়তে শুরু করেছে চালের দাম। মোকামগুলোয় চালের দাম বাড়ার পর রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই এখন চালের দাম বাড়তি। এ দফায় মোটা, মাঝারি ও সরু—সব ধরনের চালের দামই বেড়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, বছরের শুরুতে মিলমালিকেরা চালের দাম বাড়িয়েছেন। তবে মিলমালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, বাজারে ধানের সরবরাহ কমায় বেড়েছে চালের দাম।
ঢাকার বিভিন্ন বাজার ও দেশের চারটি প্রধান চালের মোকামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মান ও ধরনভেদে চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। এবার আমন ধানের ফলন ভালো হলেও ধানের উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু মৌসুমের এই সময়ে বাজারে চালের দাম এতটা বেড়ে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ দেখছেন না ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের চালের দোকান ইসমাইল অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চালের দাম হঠাৎ বেড়েছে। আর দাম যেভাবে বেড়েছে, সেটাকে ঠিক স্বাভাবিক বলা যাবে না।’ সরবরাহ কমিয়ে বাজারে চালের সংকট তৈরি করার চেষ্টা চলছে বলে মনে করেন এই বিক্রেতা।
গতকাল রোববার রাজধানীর পলাশী বাজার, নিউমার্কেট কাঁচাবাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহখানেক আগে যে মোটা চালের (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি ৫০-৫২ টাকা ছিল, তা এখন কিনতে হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকায়। মাঝারি মানের চালের (পাইজাম ও বিআর ২৮) কেজি ৫৫-৫৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-৬২ টাকা। আর মিনিকেট ও নাজিরশাইলের মতো সরু চাল ৬২-৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৬৮ থেকে ৮০ টাকা হয়েছে। কিছু সরু চাল অবশ্য বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের শুরুতে বাজারে চালের সরবরাহ কমে দাম বাড়ছিল। তবে দাম বেশি বেড়েছে নির্বাচনের ঠিক পরপর। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান প্রথম আলোকে বলেন, আমনের উৎপাদন ভালো হলেও রেকর্ড দামে ধান কিনতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি আগে দেখা যায়নি। বছরের শুরুতে ধানের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
এই ব্যবসায়ী মনে করেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সরকারকে দ্রুত বাজার তদারকিতে নামতে হবে। এই তদারকি হতে হবে সরবরাহ ব্যবস্থার একেবারে গোড়া থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, দেশে ধান উৎপাদন ভালো হয়েছে এবং খাদ্যের মজুত পরিস্থিতিও ভালো। দ্বিতীয় মেয়াদে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে গতকাল তিনি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি বলেন, মিলাররা প্রতিযোগিতা করে ধান কেনায় প্রতিনিয়ত চালের দাম বাড়ছে।
বাজারে ধান–চালের অবৈধ মজুতবিরোধী অভিযান জোরদার করা হবে—এ কথা জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এ অশুভ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে খাদ্য মন্ত্রণালয় দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। তিনি আরও বলেন, মজুতবিরোধী আইন ইতিমধ্যে পাস হয়েছে। দ্রুত বিধি প্রণয়ন করে তা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হবে।
চালের অন্যতম উৎপাদন এলাকা হিসেবে পরিচিত বগুড়া। সেখানে চালের বাজার এখন অস্থির। স্থানীয় বাজারগুলোতে সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সব ধরনের আমন চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। গতকাল খুচরা পর্যায়ে চিকন চাল বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকা কেজি। আর মোটা চাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫৪ টাকায়।
একই পরিস্থিতি দেখা গেছে ধান-চাল উৎপাদনে প্রসিদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত নওগাঁয়। জেলার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে স্থানীয় বাজারে ধানের দাম প্রতি মণে (৪০ কেজি) ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে। ধানের দাম বাড়ার কারণে মোটা ও সরু চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে।
হঠাৎ চালের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নওগাঁ মৌ অ্যাগ্রো অ্যারোমেটিক রাইস মিলের পরিচালক ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, জানুয়ারি মাসের শুরু থেকেই বাজারে ধানের দাম ঊর্ধ্বমুখী। যে স্বর্ণা ধানের দাম আগে ১ হাজার ১০০ টাকা ছিল, সেই ধান এখন কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ২৫০ টাকা মণ। তবে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে জিরা ও কাটারি ধানের। এই দুই প্রকার ধানের দাম প্রতি মণে বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
ইফতেখারুল ইসলাম আরও বলেন, ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই চালের দাম বাড়াতে হয়েছে। তবে দিনভর ঘন কুয়াশার কারণে হাসকিং মিলগুলোতে বয়লারে সিদ্ধ করা ধান শুকাতেও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। এ কারণে চালের উৎপাদন কিছুটা কম হচ্ছে।
দিনাজপুরের মতো চালের অন্যতম প্রধান উৎপাদন এলাকায়ও একইভাবে চালের দাম বেড়েছে। সেখানে ১০ দিনের ব্যবধানে প্রতি বস্তা (প্রতি বস্তায় দুই মণ বা ৮০ কেজি) ধানের দাম ১৫০-৫০০ টাকা বেড়েছে। ধানের দাম বাড়ায় প্রান্তিক কৃষকেরা খুশি। তবে তাঁরা মনে করেন, বেশির ভাগ মোটা ধান মিলমালিক এবং মজুত ব্যবসায়ী বা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে গেছে।
জেলার গোপালগঞ্জ বাজারে শুক্রবার ধান নিয়ে এসেছিলেন কৃষক জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বাজারে মোটা ধান কম। কৃষক আগেই বিক্রি করেছেন। বাজারে কেনাবেচায় যাঁদের দেখছেন, তাঁদের অধিকাংশই মজুত ব্যবসায়ী। কিছু মিলমালিকের এজেন্টও আছেন। তাঁরা কিনে রাখবেন। পরে বেশি দামে বিক্রি করবেন।’
দিনাজপুরের বাহাদুর বাজারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চাল ব্যবসায়ী বলেন, ‘মিলে ও বাজারে চালের ঘাটতি নেই। অথচ দাম বাড়ছে। উৎপাদন খরচ বাড়ছে, এটা ঠিক। তবে বর্তমান বাজারে কিছুটা অস্বাভাবিক হারে চালের দাম বাড়িয়েছেন মিলমালিকেরা।’
দেশের অন্যতম প্রধান চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে গত দুই সপ্তাহে চালের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৩-৪ টাকা। স্থানীয় লোকজন মনে করছেন, সংসদ নির্বাচনের সময় সবার মনোযোগ অন্যদিকে থাকার সুযোগে যোগসাজশ করে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে।
কুষ্টিয়া জেলার সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ধানের ভরা মৌসুম। এই সময়ে চালের দাম বাড়ানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করলে যারা দাম বাড়াচ্ছে, তাদের ধরা সম্ভব হবে।
চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সাবেক বাণিজ্যসচিব ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সরকারি গুদামে থাকা চাল দ্রুত বাজারে ছেড়ে সরবরাহ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চালের বাজারের অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা কিছু দিন সংযত ছিলেন। এখন তঁারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এঁদের থামাতে হলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় বাজার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
সম্পাদক ও প্রকাশক- মহিউদ্দিন আল আজাদ, ই-মেইল: trenadinews@gmail.com, মোবাইল-০১৭১৭-৯৯২০০৯
Copyright © 2024 সাপ্তাহিক ত্রিনদী. All rights reserved.