শেয়ারবাজারে ৭৩ কোটি টাকার নয়ছয় করেছে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আমান কটন ফাইবার্স। আইপিওর (প্রাথমিক শেয়ার) মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া ৮০ কোটি টাকা থেকে এই অনিয়ম করে প্রতিষ্ঠানটি।
এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের টাকা নির্ধারিত খাতে ব্যবহার না করে ব্যাংকে স্থায়ী আমানত বা এফডিআর করে রাখা হয়। আবার সেই এফডিআর বন্ধক (লিয়েন) রেখে গ্রুপের অন্য কোম্পানির নামে বেআইনিভাবে ঋণ নিয়েছে কোম্পানিটি।
আর্থিক প্রতিবেদনেও মিথ্যা তথ্য দিয়েছে আমান কটন। সিকিউরিটিজ আইনে যা বড় ধরনের অপরাধ। এসব কাজে সহায়তা করেছে নিরীক্ষক (অডিটর) প্রতিষ্ঠান আতা খান অ্যান্ড কোং। কোম্পানিটির আইপিও নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নিয়োগ করা বিশেষ নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ইতোমধ্যে আমান কটনের ৪ পরিচালককে ১২ কোটি টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি। অডিটরকেও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে বিএসইসি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
এ কারণে বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকারি সংস্থাটি। এরই মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে কমিশন। পাশাপাশি কোম্পানি ও অডিটরের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলার প্রস্তুতি চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু বিশেষ নিরীক্ষা নয়, এ ব্যাপারে আলাদা একটি তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কারণ, বাজারে বিনিয়োগকারীদের অর্থ নিয়ে অনিয়ম করা এ ধরনের আরও কোম্পানি রয়েছে।
কোম্পানির ইস্যু ম্যানেজার আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। শেয়ারবাজারে আসার আগে কোম্পানির প্রতিবেদন নিরীক্ষা করেছে মাহফেল হক অ্যান্ড কোং।
তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর নিরীক্ষা করেছে আতা খান অ্যান্ড কোং। এক্ষেত্রে মিথ্যা প্রতিবেদনের বৈধতা দিয়েছে এই অডিটর। অন্যদিকে ঋণের অর্থ পরিশোধ না করায় আমান গ্রুপের বিরুদ্ধে যমুনা ব্যাংক এবং এবি ব্যাংকের মামলা চলমান।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম আইপিওর টাকা ব্যবহারে অনিয়ম পাওয়ায় ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন। এরপর কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্থগিত আদেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। কমিশনও বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবেলা করবে। অন্যদিকে এ ব্যাপারে আমান কটন ফাইবার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। তবে প্রতিষ্ঠানটির কোম্পানি সেক্রেটারি শরিফুল ইসলাম , জরিমানার ব্যাপারে আপডেট তথ্য আমার কাছে নেই। আইনি কোনো উদ্যোগ আছে কি না, তাও জানি না। এ ব্যাপারে কোম্পানির লিগ্যাল ডিপার্টমেন্ট ভালো বলতে পারবে।
জানা যায়, কোম্পানিটি ২০১৮ সালে যন্ত্রপাতি কেনা ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য শেয়ারবাজার থেকে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৮০ কোটি টাকা তুলেছিল। এই টাকা নির্ধারিত খাতে ব্যবহার হয়নি। বিএসইসির কাছে এ ধরনের অভিযোগ আসার পর কোম্পানিটির কার্যক্রম মূল্যায়নে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ করে কমিশন। হাওলাদার ইউনূস অ্যান্ড কোং এই নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আইপিওর শর্ত অনুসারে ৮০ কোটি টাকার মধ্যে ৬৬ কোটি ৩৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার যন্ত্রাংশ কেনার কথা ছিল। কিন্তু ১ টাকারও কোনো যন্ত্রপাতি কেনেনি। কোম্পানিটির নামে ইসলামী ব্যাংকে ২০০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। সেখান থেকে কিছু টাকা পরিশোধের কথা ছিল। ওই ঋণ পরিশোধ করার কথা বললেও বিশেষ নিরীক্ষা কমিটিকে কোনো ধরনের ডকুমেন্ট সরবরাহ করেনি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করার কথা থাকলে সেখানে পরিশোধ করেছে ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আইপিও খাতে ব্যয়ের কথা ছিল সাড়ে ৩ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়াও ৩ কোটি টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেছে কোম্পানিটি। আইপিও থেকে ৭৩ কোটি টাকা ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এফডিআর করেছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। এর মধ্যে মেঘনা ব্যাংকে ৩৮ কোটি টাকা, বাংলাদেশে পরিচালিত শ্রীলংকার ব্যাংক কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলোনে ১৫ কোটি টাকা, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে ২০ কোটি টাকা। পরে সেই এফডিআর লিয়েন বা বন্ধক রেখে গ্রুপের অন্য কোম্পানি আকিন ক্যারিয়ার লিমিটেড এবং আমান ফুডের নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক থেকে আকিন ক্যারিয়ারের নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আবার কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের উত্তরা ব্রাঞ্চ থেকে আমান ফুডের নামে একই অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়েছে। এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে আইপিওর টাকার অপব্যবহার করেছে কোম্পানিটি। এছাড়াও কোম্পানির ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে, গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ১৭৬ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। কিন্তু ঋণের টাকা পরিশোধ না করে এফডিআর করেছে আমান কটন। এছাড়া কোম্পানিটি নিয়ম ভেঙে সহযোগী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ সরিয়েছে। তাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির মুনাফা কমেছে। এর ফলে যেসব বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কিনেছে, তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নিয়ম অনুসারে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানি তার আয়ের সর্বোচ্চ ১ শতাংশ সুবিধাভোগী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমান কটন তাদের সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১৮ শতাংশের বেশি লেনদেন করেছে। এর মাধ্যমে এক কোম্পানির অর্থ অন্য কোম্পানিতে সরিয়েছে। এসব কাজের মাধ্যমে কমিশন থেকে কোম্পানিটিকে আইপিও অর্থ ব্যবহারের যে শর্ত দিয়েছে, তা লঙ্ঘন করেছে। এছাড়াও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯-এর ১৮ ধারা লঙ্ঘন।
এ কারণে কোম্পানির ৪ পরিচালককে ১২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলামকে ৩ কোটি টাকা, অপর তিন পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলামকে ৩ কোটি টাকা, মো. তরিকুল ইসলামকে ৩ কোটি এবং মো. শফিকুল ইসলামকে ৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা পরিশোধের জন্য তাদের ১ মাস সময় দিয়েছিল কমিশন। আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রত্যেক পরিচালককে প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু তারা জরিমানার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য কমিশনের কাছে আবেদন করেন। তবে আগের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে বিএসইসি। এরপর উচ্চ আদালতে যায় কোম্পানিটি। এদিকে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনেও মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এ কারণে কোম্পানিটির নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান আতা খান অ্যান্ড কোংকেও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি। ঋণের বন্ধকি বাতিল করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো পদক্ষেপ নেয়নি আমান কটন।
এছাড়াও রাজশাহী আদালতে যমুনা ব্যাংকের করা প্রতারণা মামলায় জেলে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির তিনজন পরিচাল। যমুনা ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে মেসার্স আরএসএন্ডটি ইন্টারন্যাশনালের নামে ঋণ নিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ও আমান গ্রুপের পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কাছে যমুনা ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৮৮ কোটি টাকা। নিয়ম অনুসারে, এই ঋণের বিপরীতে ১১৩ শতক জমি বন্ধক রাখা হয়। আমান গ্রুপের অপর দুই পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম ও পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ওই ঋণের জামিনদার ছিলেন। ঋণগ্রহীতা তৌফিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে ঋণের কিস্তি শোধ করেননি। এর মধ্যে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, অভিযুক্তরা গোপনে জালিয়াতির মাধ্যমে বন্ধকি সম্পদ অন্য জায়গায় বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। এ ঘটনায় যমুনা ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ম্যানেজার ২০১৯ সালে শাহমাখদুম থানায় একটি প্রতারণা মামলা করেন। যার নং সিআর মামলা নং-২৮ সি/১৯। ওই মামলায় আসামিরা হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছিলেন। জামিনের মেয়াদ শেষ হলে উচ্চ আদালতের আদেশে গত বছরের ২৩ মে তারা নিু আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করেন। কিন্তু আদালত জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। অন্যদিকে ঋণের অর্থ পরিশোধ না করায় আমান গ্রুপের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেছে বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক লিমিটেড। আমান কটন ফাইবার্স ছাড়াও এই গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান আমান ফিড শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। এই কোম্পানিটি এবি ব্যাংকের কাছে ঋণখেলাপি। কোম্পানিটিকে দেওয়া ঋণের অর্থ আদায় করতে না পেরে মামলা করেছে এবি ব্যাংক। ঋণ আদায়ে আমান ফিডের কারখানা, ভবন ও জমি বিক্রি করার জন্য নিলাম ডেকেছিল এবি ব্যাংক। তবে কোম্পানিটি উচ্চ আদালত থেকে এ নিলামের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসে। পরে আদালত কোম্পানিটিকে ওই ঋণ পরিশোধের জন্য সময় বেঁধে দেন।
সম্পাদক ও প্রকাশক- মহিউদ্দিন আল আজাদ, ই-মেইল: trenadinews@gmail.com, মোবাইল-০১৭১৭-৯৯২০০৯
Copyright © 2024 সাপ্তাহিক ত্রিনদী. All rights reserved.