কেজরিওয়ালের গ্রেফতারে মোদির জন্য অশনিসংকেত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। রেকেজরিওয়ালের গ্রেফতার নিয়ে ভারতের বিরোধীরা আবারো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারন ভারতে লোকসভা নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করার ঘটনা দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কেননা ভারতের ইতিহাসে কেজরিওয়ালই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি পদে থাকাকালীন গ্রেফতার হলেন। শুক্রবার (২২ মার্চ) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
আবগারি দুর্নীতি মামলায় বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানী দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করে ভারতের ইনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে দেশটির বিরোধীদলীয় নেতারা। তাদের মধ্যে ইন্ডিয়া জোট থেকে সম্প্রতি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অনেক নেতাও রয়েছেন। এ ঘটনায় দেশটির জনগণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে ‘বিপ্লব’ করতে পারেন বলে সতর্কও করেছেন কতিপয় নেতা।
প্রয়োজনীয় নথি দেখিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে তল্লাশি শুরু করে ইডির ১২ জন সদস্য। এ সময় তার বাড়ির সামনে বিপুল পরিমাণ পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির (এএপি) এক মুখপাত্র বলেছেন, একটি ‘বোগাস মামলা’ নিয়ে মোদি ‘নোংরা রাজনীতি’ করছেন। আল জাজিরাকে তিনি বলেছেন, তাদের দলনেতা পদত্যাগ করবেন না। বরং ‘কারাগারে থেকেই সরকার চালাবেন।’
দিল্লির আবগারি দুর্নীতি মামলায় কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করা হয়। দিল্লি সরকারের ২০২১-২২ সালের আবগারি নীতি বেশ কিছু মদ ব্যবসায়ীকে সুবিধা করে দিচ্ছিল। এই নীতি প্রণয়নের জন্য যারা ঘুস দিয়েছিলেন, তাদের সুবিধা করে দেওয়া হয়েছিল বলে তার সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে।
এদিকে ইডি জানিয়েছে, আবগারি মামলায় এএপি প্রধানকে নয় বার সমন পাঠানো হয়; কিন্তু আটবারই হাজিরা এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। শেষ পাঠানো সমনে বৃহস্পতিবারই ইডি দফতরে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর। তবে দুর্নীতির অভিযোগ বরাবরের মতোই অস্বীকার করেছে এএপি প্রধান। হাজিরা না দিয়ে নিরাপত্তা চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন কেজরিওয়াল। তবে হাইকোর্ট কোনো সুরক্ষা না দেওয়ায়, শেষে সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করেন তিনি।
এদিকে যে কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে মোদি সরকার।
ভারতের বৃহত্তম বিরোধী দল কংগ্রেস বৃহস্পতিবার সকালে বলেছিল, চলমান ট্যাক্স বিরোধের কারণে নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনও প্রকার প্রচার চালাতে পারেনি তারা। কেননা তাদের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে রাখা হয়েছে।
আলজাজিরাকে এক বিবৃতিতে দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং কেজরিওয়ালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৌরভ ভরদ্বাজ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যা ইচ্ছা করতে পারেন। এখন পর্যন্ত দুইজন মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করেছে তারা এবং আরও মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করতে পারে।
গত মাসে হেমন্ত সোরেনকে গ্রেফতার করেছিল ইডি। দুর্নীতির অভিযোগে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করার কয়েকঘণ্টা পরই তাকে গ্রেফতার করা হয়। এএপি এবং কংগ্রেসের মতো সোরেনের দল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চাও ভারতের বিরোধী জোটের অংশ। এটি আসন্ন নির্বাচনে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সঙ্গে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
বিশ্লেষকরা বলেন, কেজরিওয়ালের গ্রেফতারের ঘটনাটি মোদি এবং বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে। কেননা সম্ভাব্যভাবে লক্ষ্যবস্তু করা নেতাদের প্রতি জনগণের সহানুভূতি তৈরি হয়ে থাকে। এমনকি এ ঘটনার পর যৌথ হুমকি মোকাবিলায় বিভক্ত বিরোধীরা বৃহত্তর ঐক্য গঠনও করতে পারেন।
কেজরিওয়ালকে গ্রেফতারের পরপরই তার বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন আম আদমি পার্টির সমর্থকরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তিও হয়। দিল্লিজুড়েই বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু করেন তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
শত শত বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বলেছিলেন ৩৪ বছর বয়সি এএপি কর্মী দেবেন্দর সিং। আলজাজিরাকে তিনি বলেছেন- ‘এটি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য অশোভন। একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী জনসম্মুখে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। মোদির মনে কি চলছে?’
২০১১ সালে আম আদমি পার্টি (এএপি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কেজরিওয়াল। ২০১৫ সালে ২০২০ সালে মোদির শক্তিশালী দল বিজেপির বিরুদ্ধে লড়েই তুমুল নির্বাচনি জয় পেয়েছিলেন তিনি। ৭০ সদস্যের বিধানসভা নির্বাচনে ২০১৫ সালে ৬৭ এবং ২০২০ সালে ৬২টি আসন জিতেছিলেন।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার অসীম আলি বলেছেন, কেজরিওয়ালের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে মোদি সরকার শুধু নিজেকে কর্তৃত্ববাদী এবং অহংকারী হিসেবেই উপস্থাপন করছে না, বরং বিজেপি এবং এএপির মধ্যে কাকে ভোট দিবে- এমন সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা ভোটারদেরও হাতছাড়া করার ঝুঁকি তৈরি করেছে। ওই সব ভোটারদের এখন ‘সহানুভূতিবশত এএপিকে সমর্থন করতে পারে। এমনকি কংগ্রেসকেও ভোট দিতে পারে তারা।’
তিনি বলেন, কেজরিওয়ালকে শহিদ বানাতে চাওয়া বিজেপির জন্য ঝুঁকির।
ভারতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বোর্ডের চেয়ারম্যান আকার প্যাটেল আলজাজিরাকে বলেছেন, গ্রেফতারের ঘটনা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হতাশা এবং মানবাধিকারের প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞা প্রদর্শন করে।
কেজরিওয়ালের গ্রেফতার নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নিন্দার বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। সেসব দলগুলো সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইন্ডিয়া ব্লক থেকে দূরে সরে গেছে।
তাকে গ্রেফতারের কয়েক মিনিট পরই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, একজন ভীত স্বৈরশাসক একটি অকেজো গণতন্ত্র তৈরি করতে চায়।
পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব রাজ্য শাসনকারী দল তৃণমূল কংগ্রেস। এটি সাম্প্রতিক দিনগুলোতে স্বাধীনভাবে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইন্ডিয়া জোটের সাবেক সদস্য হওয়া সত্ত্বেও কেজরিওয়ালের গ্রেফতারের সমালোচনা করেছে দলটি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে করা একটি পোস্টে তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন প্রশ্ন করেন, নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগেই যদি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এবং বিশিষ্ট বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করা হয়ে, তাহলে আমরা কিভাবে ভারতে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করব?
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্টালিন এই গ্রেফতারের ঘটনাটিকে একটি ‘ফ্যাসিবাদী’ পদক্ষেপ বলে সমালোচনা করেছেন।
কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন একে একটি ‘সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে সব বিরোধী কণ্ঠকে নীরব করার একটি নির্মম চক্রান্তের অংশ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। স্ট্যালিনের দ্রাবিড় মুন্নেত্র কাজগম এবং বিজয়নের কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া উভয়ই ইন্ডিয়া জোটের অংশ।
একই ব্লকের আরেক সদস্য উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের দল সমাজবাদী পার্টি। তিনি বলেছেন, কেজরিওয়ালের গ্রেফতার ‘একটি নতুন জনগণের বিপ্লবের জন্ম দেবে’। তিনি আরও বলেছিলেন, বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার এটিই প্রমাণ করে যে বিজেপি আসন্ন নির্বাচনে ‘পরাজয়ের ভয়ে ভীত’।
বিজেপি অবশ্য কেজরিওয়ালের গ্রেফতারের প্রশংসা করেছে। দলটি কেজরিওয়ালকে ‘মদ কেলেঙ্কারির রাজা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সম্বিত পাত্র কেজরিওয়ালকে খোঁচা দিয়ে বলেছিলেন, ‘এএপি বলেছে অরবিন্দ কেজরিওয়াল একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি ধারণা। আমার বলা উচিত, তিনি একটি খারাপ ধারণা।’