চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের পূর্ব কাজিরগাঁও গ্রামের বড় বাড়ির মৃত সৈয়দুর রহমানের ছেলে শহিদ মো. আবুল কালাম। পরিবার নিয়ে থাকতেন কুমিল্লায়। পেশায় ছিলেন আইনজীবী। গত বছরের ৫ আগস্ট আদালত থেকে ফেরার সময় গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসাধীন থেকে ১৬ আগস্ট তিনি মারা যান। গ্রামের বাড়িতে কোনো বসতঘর না থাকায় তার পরিবার কুমিল্লায় ভাড়া বাসায় থাকেন। এদিকে, স্বামীকে হারিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে বর্তমানে অসহায় জীবনযাপন করছেন এ শহিদ পরিবারের সদস্যরা।
মো. আবুল কালাম। জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে। বাবা মৃত সৈয়দুর রহমান, মা মৃত তফুরা বেগম। শহিদ মো. আবুল কালাম ১৯৮৩ সালে এসএসসি পাস করেন হাজীগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে, ১৯৮৫ সালে পায়েলগাছা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৮৮ সালে হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে কুমিল্লা ‘ল’ কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির সদস্যভুক্ত হন এবং আইনজীবী পেশায় যুক্ত হন। সম্প্রতি এ শহিদের বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রী ও মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
শহিদ আবুল কালামের স্ত্রী ও দুই মেয়ে বর্তমানে কুমিল্লা নান্না দীঘির পাড়ে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন। বড় মেয়ে নিশাত জাহান মম (২৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে অস্থায়ীভাবে চাকরি করছেন। ছোট মেয়ে তাছনিয়া অনি চলতি বছর এসএসসি পাস করেছেন।
স্ত্রী ও মেয়েরা জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট আদালত থেকে বাসায় ফেরার সময় সড়কে এসেই গোলাগুলির মধ্যে পড়েন। ওই সময় পেছন দিক থেকে তার মেরুদণ্ডে গুলি লাগে। সেখানেই তিনি লুটিয়ে পড়লে সহকর্মী আইনজীবীরা উদ্ধার করে প্রথমে তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা পপুলার হাসপাতালে। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ আগস্ট মারা যান। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।
এদিকে, ১৬ আগস্ট কুমিল্লা জজ আদালত প্রাঙ্গণে বাদ জুম এই শহিদের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ওই দিন বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বাদ আছর বাড়ির পাশের মসজিদের সামনে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
স্ত্রী হাসিনা সুলতানা জানান, তার স্বামী খুবই সহজ সরল ছিলেন। আন্দোলনের শুরু থেকে তিনি আহত এবং নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের পক্ষে থেকে আইনি সেবা দিয়েছেন। তিনি কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির দুইবার নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।
তিনি আরও জানান, ১৯৯৯ সালে বড় মেয়ে এবং ২০০৮ সালে ছোট মেয়ের জন্ম হয়। এরপর থেকে খুবই কষ্টের মধ্যে থেকে সংসার চালিয়েছেন। মেয়েরা যেন পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হয় এবং তার স্বপ্ন পূরণ করে এটাই ছিল তাদের বাবার স্বপ্ন। তিনি মারা যাওয়ার পরে আমরা খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি। অভিভাবক ছাড়া দুই মেয়েকে নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। বাড়িতে জমি থাকলেও বসতঘর নেই। বড় মেয়ের কর্মস্থল এবং ছোট মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
বড় মেয়ে নিশাত জাহান মম জানান, বাবার স্বপ্ন ছিল আমি বিসিএস ক্যাডার হব। সেই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। ছোট মেয়ে তাছনিয়া অনি জানান, বাবা নেই এখনো মানতে পারছি না। বাবার শূন্যতা আমাকে খুবই বেদনা দেয়। কারণ আমার সব চাওয়া-পাওয়া ছিল বাবার কাছে। বাবার স্বপ্ন ছিল আমি আইনজীবী হই। সবার সহযোগিতা থাকলে বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে পারবো।
শহিদ কালামের চতুর্থ ভাই শোয়েব হোসেন জানান, ভাই কুমিল্লা থাকলেও যে কারো বিপদে এগিয়ে আসতেন। এলাকার গরিব মানুষদের খোঁজ খবর নিতেন। এলাকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সব সময় কাজ করতেন। আমরাও চেষ্টা করবো ভাইয়ের এ কাজ অব্যাহত রাখতে।
শহিদ আবুল কালামের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সখ্যতা ছিল ছোট ভাই আবু সালাত রাসেলের। ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত কথা হতো। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার সময় রাসেল তার সঙ্গেই ছিলেন। তিনি জানান, বাবা-মা বেঁচে থাকা অবস্থায় সব সময় ভাই খোঁজ খবর নিতেন। কখন কি লাগবে এই নিয়ে অস্থির থাকতেন। আমাকে বলতেন, কথা কম বলবে শুনবে বেশি। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে থেকেও আমাকে সতর্ক হয়ে চলার জন্য বলেন।