একজন মা তার নিখোঁজ সন্তানকে সর্বত্র খুঁজে বেড়াবেই এবং যতদিন পর্যন্ত তার শরীরে শক্তি আছে, ততদিন পর্যন্ত তিনি তার খোঁজ থামাবেন না। এক্ষেত্রে তার সন্তান জীবিত না কি মৃত, সেটি কোনও বিষয় না তার কাছে।
গত চারদিন ধরে কারিমা এলরাস গাজার আল নাসের হাসপাতালের গণকবরের কোলাহল, ধুলাবালি ও অসহনীয় দুর্গন্ধের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।তিনি ২১ বছর বয়সী সন্তান আহমেদের মা, যিনি গত ২৫ জানুয়ারি দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহরে নিহত হন। কিন্তু এরপর থেকে আহমেদের লাশ নিখোঁজ রয়েছে।
গত মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল কারিমা অবশেষে তার ছেলেকে খুঁজে পান। তিনি বলেন, আমি এখানে বারবার এসেছি। আমার ছেলের, আমার পুত্র আহমেদের, আমার আদরের ছোট্ট ছেলে, আমার ভালোবাসার লাশ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত। ওর বয়স যখন ১২ বছর, তখন ও ওর বাবাকে হারিয়েছে এবং তারপর থেকে আমিই ওকে বড় করেছি।
অন্যান্য পরিবারগুলো গণকবরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। হতাশাজনক হলেও বিশ্বের সব যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলেরই খুব পরিচিত দৃশ্য এটি।
মৃতদেরকে খুঁজে পাওয়ার জন্য বুলডোজারগুলো মাটি খুঁড়ছে। মাটির নিচ থেকে একটি শক্ত হাত প্রসারিত হয়ে আছে। কবর থেকে উত্তোলিত মরদেহ সমাধিস্থ করার জন্য আলাদা আলাদা স্থান চিহ্নিত করছেন খননকারীরা। প্রিয়জন হারানো পরিবারগুলো আশা করে আছে যে কবর থেকে উত্তোলন করা মৃতদেহগুলোর মাঝে তাদের খুঁজে পাবে।
কিন্তু এমন দৃশ্যের ব্যাখ্যা সবসময় একইরকম না। প্রতিটি গণকবর- সেটি হোক বলকান অঞ্চলের দেশগুলো, মধ্য আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, অথবা অন্য কোথাও- সেখানকার স্থানীয় অবস্থার ফলাফল।
গাজায় ইসরায়েলের নির্মম হামলায় ৩৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। অবরুদ্ধ এই উপত্যকাটিতে ২৩ লাখ মানুষ জনাকীর্ণ স্থানে বাস করে। সেটি আরও সঙ্কুচিত হয়েছে এবং এত সংখ্যক মৃতদেহ দাফন করা বেশ জটিল ও বিপজ্জনক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিছু করবস্থানে কোনও জায়গাই আর খালি নেই। আবার চলমান লড়াইয়ের কারণে অন্য কবরস্থানগুলোতে পৌঁছানোটাও অসম্ভব। এইসব কারণে মৃতদেহগুলোকে হাসপাতাল চত্বরেই কবর দেওয়া হচ্ছে, যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী নির্মম অভিযান চালিয়েছে।
বিবিসির সাংবাদিক প্রতিবেদনে লিখেছেন, আমি এর আগে কিছু যুদ্ধ নিয়ে রিপোর্ট করেছি। সেসব ক্ষেত্রে এটি খুব দ্রুততার সাথে যুক্তিসঙ্গতভাবে বলা সম্ভব ছিল যে ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে আসলে কী হয়েছে। এটা বলা সম্ভব ছিল, কারণ ময়নাতদন্তকারীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতো এবং সাংবাদিকরাও দ্রুত ওই এলাকায় প্রবেশ করতে পারতো।
কিন্তু গাজার বর্তমান পরিস্থিতি, যেখানে ইসরায়েল ও মিশর আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের কাছে কিছু জানাতে করতে অস্বীকার করছে এবং ময়নাতদন্তকারীদের যে কোনও দলের জন্য এই সংঘাত অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
গণকবরে পাওয়া শত শত মৃতদেহ কী মেডিকেল কমপ্লেক্সের ভেতরে ও চারদিকে হওয়া বিমান হামলা ও লড়াইয়ের শিকার? না কি তারা যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট কোনও রোগ ও অপুষ্টিতে ভুগে মারা গেছে? না কি ইসরায়েলি বাহিনী এই মৃতদেহগুলোকে একটি কবর থেকে আরেকটি নতুন কবরে স্থানান্তর করেছে?
গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে যে, ৩৩০টিরও বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু ওই মানুষগুলো কখন ও কীভাবে মারা গেলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে পারছি না। ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানের আগে ওখানে কতগুলো মৃতদেহকে দাফন করা হয়েছে, নাসের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেই হিসাব রাখতে পারে। কিন্তু আমরা তা জানি না।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী নিশ্চিত করেছে যে হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের মধ্যে কেউ ছিল কি না, তা দেখার জন্য তারা হাসপাতাল প্রাঙ্গণের কবরগুলো খুঁড়ে মৃতদেহগুলোকে বের করে পরীক্ষা করেছে এবং পরীক্ষা শেষে তাদের জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্কাই নিউজ ভিডিও এবং স্যাটেলাইট ইমেজ যাচাই করেছে। সেখানে দেখা যায় যে অভিযান পরিচালনার সময় ইসরায়েলি বুলডোজারগুলো হাসপাতাল প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে চলে গেছে। ফলে ওই স্থানের দৃশ্যমান ক্ষতি হয়েছে।
ফিলিস্তিনি অঞ্চলের জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের পরিচালক অজিথ সাংহে আমাকে বলেছেন, কবরগুলোর একটি স্বাধীন ময়নাতদন্ত করতে হবে। মঙ্গলবার জাতিসংঘের আরেক কর্মকর্তা জানান, হাত বাঁধা অবস্থায় কিছু লাশ পাওয়া গেছে।
উদ্ধার ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনাকারী একটি দল প্যালেস্টেনিয়ান সিভিল ডিফেন্সের এক কর্মকর্তার বক্তব্যের সাথে এই কথার মিল পাওয়া যায়। ওই কর্মকর্তাও বলেছিলেন যে, মৃতদেহদেরকে হাত বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে, কিছু মৃতদেহকে মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখা গেছে এবং কয়েকজনকে বন্দিদের পোশাক পরিহিত অবস্থায়ও পাওয়া গেছে।
রিম জেইদান, যিনি দুই সপ্তাহ ধরে তার ছেলে নাবিলের লাশের খোঁজ করছেন। সবশেষে বুধবার বিকেলে তিনি তার ছেলের লাশ খুঁজে পেয়েছেন। রিম বলেন, তিনি মৃতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন। সেইসঙ্গে, মৃতদেহগুলোর হাত বাঁধা ছিল।
তিনি বলেন, তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিলো। কাউকে কাউকে আবার হাত ও পা একসাথে বেঁধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আর কতকাল এটি চলবে?
এদিকে হাসপাতালে মৃতদেহ দাফন করার বিষয়টিকে মিথ্যা ও মানহানিকর আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। আইডিএফ বলেছে, গত সাতই অক্টোবর যাদেরকে জিম্মি করে হামাস গাজায় নিয়ে গিয়েছিলো, তাদের মাঝে কেউ ছিল কি না, তা দেখতে মৃতদেহগুলোকে তোলা হয়েছে। সূত্র: বিবিসি