মহিউদ্দিন আল আজাদ:
দখল, দূষণ ও আবর্জনা ফেলায় মৃত প্রায় চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ পৌরসভাধীন মিঠানীয়া খালটি। এতে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি গ্রীষ্ম মৌসুমে পানির অভাবে বহুদিন ধরে মকিমাবাদ, খাটরা-বিলওয়াই, কাজিরগাঁও, দোয়ালিয়া ও মাতৈনসহ প্রায় ১১টি স্কীমের আওতাধীন মাঠের অধিকাংশ স্থানে ফসলের জমি অনাবাদী হয়ে পড়েছিল। খালটি পুনরুদ্ধার ও খননে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কাছে দীর্ঘদিন ধরে কৃষক, এলাকাবাসীসহ সংশ্লিষ্ট উপকারভোগীরা দাবি জানিয়ে আসলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। খালটি সংস্কার হলে প্রায় ২০ হাজার কৃষক উপকৃত হবে। বাড়বে ধান উৎপাদন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজারস্থ কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের মিঠানীয়া ব্রীজের নিচে এবং খালের দুই পাশে (উত্তর ও দক্ষিণ) পাশে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও আশ-পাশের এলাকার মানুষ আবর্জনা ফেলা এবং খালে কচুরিপানা ও নেপিয়ার ঘাসের কারণে পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও খালের উপরে থাকা ড্রেজার পাইপের জোড়া অংশের লিকেজ দিয়ে বালু পড়ার কারণে খালের মুখটি প্রায় ভরাট হয়ে গেছে।
এর পাশাপাশি মিঠানিয়া ব্রীজ নির্মাণের সময় খালের উপর বিকল্প সড়ক স্থাপন এবং ব্রীজ চালুর পর পরবর্তীতে ওই বিকল্প সড়কের মাটি ভালো সরিয়ে না নেওয়ার কারণে সেচের পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে প্রায় সহস্রাধীক একর জমির চাষাবাদ হুমকি মুখে। খালটি খনন করা হলে অনাবাদি জমিতে চাষাবাদসহ হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের প্রায় ১১টি স্কীমের কয়েক হাজার কৃষক উপকৃত হবেন এবং বাড়বে ফসলের উৎপাদন।
জানা গেছে, হাজীগঞ্জ পৌরসভাধীন ৩নং ওয়ার্ডের ডাকাতিয়া নদী থেকে শুরু করে মিঠানিয়া খালটি হাজীগঞ্জ পৌরসভা হয়ে হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন উপর দিয়ে বিভিন্ন খালের সাথে সংযোগ। এই খাল দিয়ে একসময় নৌকাযোগে উত্তরাঞ্চলের লোকজন চলাচল করতেন। বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পরিমানে মাছ নিধন করে মানুষ পারিবারিক চাহিদা পূরণ করে সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হতেন। এখন সেই খাল মৃতপ্রায়।
এছাড়াও খালটির সবচে বড় ভুমিকা ছিল ফসল উৎপাদনে। খালের পানি ব্যবহার করে পৌরসভাধীন ৩, ৪ ও ৫নং ওয়ার্ডের খাটরা বিলওয়াই ও মকিমাবাদ গ্রাম, হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সুদিয়া, মাতৈন, দোয়ালিয়া, মৈশাইদ, খাকবাড়িয়া, বাড্ডা, বাউড়া, শাহপুর, সুবিদপুর, মাড়ামূড়া ও কালচোঁ গ্রামের একাংশ প্রায় ২০ হাজার কৃষক ফসল ফলাতেন। কিন্তু দিনে দিনে খালটি দূষণ ও দখলের কারণে গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি প্রবাহ অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়।
বিশেষ করে পৌরসভাধীন এলাকার হাজীগঞ্জ বাজারস্থ মিঠানিয়া ব্রীজের দক্ষিণ ও উত্তর পাশে আবর্জনা, দখল ও দূষণের ফলে খালটির পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়ে। স্থানীয়রা কৃষকরা জানান, এভাবেই কয়েক বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে খালটি পুনরুদ্ধার ও খননে জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনের কাছে বহুবার বলা হলেও আশাহুত হয়ে ফিরতে হয়েছে তাঁদের। অথচ এই খালটি দিয়ে সাত-আটটি বিলের পানি নিষ্কাশন ও ১১টি স্কীমের জমিতে পানি সেচ দিয়ে থাকে।
গতবছর স্ক্রীম ম্যানেজারদের উদ্যোগে এবং তাদের নিজস্ব অর্থায়নে মিঠানিয়া ব্রীজের দুই পাশ থেকে ময়লা-আবর্জনা ও মাটি অপসারণ করে সেচের পানি প্রবাহে ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এবছর আবারও খালের মুখটি ভরাট হয়ে গেছে।
অপর দিকে এই খালের আওতাধীন দোয়ালিয়া উজ্জ্বল স্কীমের ড্রেন (নালা) দিয়ে মাতৈন, সুদিয়া, বাড্ডা, বাউড়া ও শাহাপুরের একাংশসহ ৫ গ্রামের জমিতে পানি সেচ হয়ে থাকে। কিন্তু নালাটি সংস্কার না হওয়ায় এবং অসংখ্য ইঁদুরের গর্ত থাকার কারণে সকল জমিতে পানি সেচ দেওয়া যাচ্ছেনা। এতে প্রায় শতাধিক একর জমি অনাবাদি হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। তাই, এই ড্রেনটিসহ অন্যান্য সকল ড্রেন পাকাকরণের আবেদন জানান তারা।
ওই সময়ে খাটরা-বিলওয়াই মাঠের স্কীম ম্যানেজার মো. আবুল হাসেম অভিমানের সুরে বলেন, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তাসহ কতজনের কাছে কৃষকরা গিয়েছে, কোন কাজ হয়নি। সামনে হবে কিনা তাও জানি না।
কথা হয় হোসেন মিজি, আব্দুল মালেক, এমদাদুল হক, মো. ইমান হোসেন ও মো. নজরুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন কৃষকের সাথে। তারা জানান, এই অঞ্চলের জমিগুলো এক ফসলি। অর্থ্যাৎ বছরে একবার ফসল উৎপাদন হয়। এই ফসল দিয়ে তাদের পারিবারিক জীবিকা নির্বাহ ও গো-খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। অথচ মিঠানিয়া খাল ও স্কীমগুলোর আওতাধীন ড্রেনের সংস্কার না করার কারণে তারা চাহিদা অনুযায়ী সেচের পানি পাচ্ছেনা।
এ বিষয়ে দোয়ালিয়া উজ্জ্বল মাঠ স্কীমের ম্যানেজার মো. দেলোয়ার হোসেন দুলাল জানান, মিঠানীয়া খালটি দ্রুত খননসহ স্কীমের ড্রেন পাকাকরণ প্রয়োজন। তা না হলে কয়েক শতাধীক একর জমি অনাবাদী হবে। পাশাপাশি বর্ষাকালে এসব অঞ্চলে জলাবদ্ধতা দেখা দিবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিলরুবা খানম জানান, খালটি খননের বিষয়ে বিএডিসি’র ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা হয়েছে। স্থায়ী কিছু করা যায় কিনা, এ বিষয়ে আমি ইউএনও মহোদয়সহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবো।
উপজেলা বিএডিসির কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সেচ) মো. মামুন রশিদের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, খালটির পানি প্রবাহে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে ইউএনও মহোদয়ের সাথে কথা বলে এবং আমার উর্ধ্বত কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাপস শীল বলেন, খালটি খননসহ টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।