সিন্দুক খুললেই বস্তায় বস্তায় টাকা! আটটি সিন্দুকের সব টাকা-পয়সা ভরা হয় ২০টি বস্তায়। উপস্থিত লোকজনের ধারণা, এবার মিলতে পারে চার কোটি বা আরো বেশি টাকা! ৯৭ দিন পর আজ শনিবার সকালে খোলা হলো কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের সিন্দুক। সাধারণত ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে ভরে যায় সিন্দুকগুলো। এ কারণে প্রায় তিন মাস পর পর খোলা হয় এগুলো। আর সিন্দুকে পাওয়া এই ২০ বস্তা টাকা গণনা হবে সারা দিন।
সব শেষে গত অক্টোবর মাসের ১ তারিখে খোলা হয়েছিল সিন্দুক। সেদিন পাওয়া যায় তিন কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার ৮৮২ টাকা। এর আগে ২ জুলাই বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার বাদে পাওয়া যায় তিন কোটি ৬০ লাখ ২৭ হাজার ৪১৫ টাকা। তারও আগে মার্চে পাওয়া যায় তিন কোটি ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। এ হিসাবে গড়ে প্রতিবারেই প্রায় তিন কোটি ৭৬ লাখ টাকা পাওয়া গেছে সিন্দুকে।
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কঠোর নিরাপত্তা আর বেশ কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে খোলা হয় মসজিদের সব সিন্দুক। স্থানীয়রা জানায়, শুধু মুসলমান নয়, অন্য ধর্মের লোকজনও পাগলা মসজিদে বিপুল অঙ্কের টাকা-পয়সা দান করে। এই মসজিদটি সব ধর্মাবলম্বীর কাছে পবিত্রতার প্রতীক ও আস্থার জায়গা। তাঁদের ধারণা, এখানে দান করলে আয়-উন্নতি বৃদ্ধিসহ বিপদ-আপদ দূর হবে। পূরণ হয় মনোবাসনা। এ কারণে এই মসজিদের দান বাক্সে যে বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়, তা জেলার আর কোনো মসজিদে ওঠে না। শুধু কী টাকা! টাকার সঙ্গে সোনা-রুপার অলঙ্কারসহ থাকে বিদেশি মুদ্রাও।
আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সিন্দুকে পাওয়া চিঠিপত্র। এসব চিঠিতে লোকজন কত বাসনার কথা যে লেখে! প্রেম-বিরহ, স্বামী-স্ত্রীর ভুল বোঝাবুঝি, পেশা ও আয়-রোজগারের সমস্যা, শত্রুতা, জটিল রোগ থেকে মুক্তি, সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আবেদনসহ আরো কত কিছু লেখেন তারা। বিপুল টাকা-পয়সার জন্য সংগত কারণেই সিন্দুক খোলার সময় নেওয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। জেলা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বড়সড় দল সারা দিন টাকা-পয়সা গণনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকে।
সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিন্দুকের টাকা-পয়সা বস্তাবন্দি করছে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন। পরে বস্তাগুলো ধরাধরি করে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এবার সব মিলিয়ে ২০ বস্তা টাকা পাওয়া গেছে বলে জানান সিন্দুক খোলা উপকমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী। তিনি বললেন, পাগলা মসজিদের টাকা জমা হয় রূপালী ব্যাংকে, এই ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মসজিদ কমিটির লোকজন, মাদরাসার ছাত্রসহ সব মিলিয়ে প্রায় দু’শতাধিক লোক সারা দিন টাকাগুলো গুনবে।
জানা গেছে, মসজিদের বিপুল অর্থ-সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ২৯ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। পাগলা মসজিদের সাধারণ সম্পাদক ও কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. পারভেজ মিয়া জানান, মসজিদের দানের টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত থাকে। আর ওই টাকার লভ্যাংশ থেকে গরিব ও অসহায় লোকদের আর্থিক সহায়তা, ক্যান্সারসহ জটিল রোগে আক্রান্তদের আর্থিকভাবে অনুদান দিয়ে মসজিদটি আর্তমানবতার সেবায় ভূমিকা রাখছে। তা ছাড়া করোনা মহামারির সময় মসজিদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা রোগীদের সেবায় যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র কিনে দেওয়া হয়েছে। দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনুদান দেওয়া হয় মসজিদের তহবিল থেকে। এইসব সেবামূলক কর্মকাণ্ড সারা বছরই করে থাকে পাগলা মসজিদ।
মসজিদের সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে দানের টাকা জমানো হচ্ছে। এ টাকায় এখানে আন্তর্জাতিক মানের একটি দৃষ্টিনন্দন বহুতল কমপ্লেক্স হবে। যেখানে ৬০ হাজার মুসল্লির একসঙ্গে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা থাকবে। নারীদের জন্য পৃথক নামাজের ব্যবস্থাও থাকবে সেখানে। থাকবে সমৃদ্ধ লাইব্রেরিসহ আরো নানা আয়োজন। এ প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে ১১৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিমে হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে মাত্র ১০ শতাংশ ভূমির ওপর এই মসজিদটি গড়ে উঠেছিল। সময়ের বিবর্তনে আজ এ মসজিদের পরিধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এর পরিচিতিও।