ঢাকা ১০:৩১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাঘের মুখ থেকে ফিরে এসে ১১ বছর পর আগের পেশাতেই ‘টাইগার কামাল’

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৫:৩৭:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • ৬২ Time View

ত্রিনদী অনলাইন নিউজ ডেস্ক :

খুলনার কয়রা উপজেলার ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের কামাল হোসেনকে সবাই ‘টাইগার কামাল’ বলে ডাকেন। সুন্দরবনে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ফিরে আসায় তাঁর এই নাম ছড়ায়। বাঘের মুখে পড়ার সেই ভয়ংকর ঘটনাটি কামালের জীবনে ঘটেছিল ১১ বছর আগে।

সাহস নিয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে ও ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে ফিরলেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন কামাল। তারপর দীর্ঘ চিকিৎসায় একসময় সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে জীবিকার তাগিদে সেই কামালকে সুন্দরবনে মাছ ধরার পেশাতেই ফিরে যেতে হয়েছে।

কামাল হোসেন বলেন, সুস্থ হয়ে আর সুন্দরবন যাবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে ভাগ্যের টানে আবারও সেই সুন্দরবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, বনের কাজে তাঁর কোনো ক্লান্তি আসে না। বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে এখন সুন্দরবন থেকে মাছ, কাঁকড়া, মধু আহরণ করেন। কখনো একা, আবার কখনো দল বেঁধে বনে যান।

গত সোমবার ৪ নম্বর কয়রা এলাকায় কামাল হোসেনের সঙ্গে দেখা হয়। সুন্দরবনে বাঘের মুখ থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা জানান তিনি। কামাল হোসেন বলেন, সুন্দরবন ঘিরেই তাঁর বেড়ে ওঠা, জীবন–জীবিকা। ২০১১ সালে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে একদিন বেলা একটার দিকে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রুহুল আমিন সরদার নামের একজন। বনের গোড়াচালকি খালে মাছ ধরছিলেন তাঁরা। হঠাৎ উৎকট গন্ধ নাকে এসে লাগে।

মাথা উঁচু করে খালপাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন একটি বাঘ পলকহীন চোখে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। কিছু বোঝার আগেই ঝোপের মধ্য থেকে বাঘটি তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চিত হয়ে খালের ভেতর কাদায় পড়ে যান। প্রথমে বাঘটি তাঁর মাথার বাঁ পাশে থাবা দিয়ে ছিলে ফেলে। প্রায় ২০ মিনিট বাঘটি তাঁর পেটের ওপর বসে থাকে। তখনো তাঁর চেতনা ছিল। হঠাৎ তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে চিৎকার, ‘বাঁচাও…’।

কামাল হোসেনের সঙ্গী রুহুল আমিন সরদার এখনো পুরোদস্তুর বনজীবী। চোখের সামনে ভয়ংকর সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রুহুল আমিন সরদার বলেন, জঙ্গল থেকে বাঘ বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে কামালের ওপর। দূর থেকে কামালের মাথায় রক্তক্ষরণ দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন কামাল মারা গেছে।

তারপর যখন কামাল হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে তখন এলোপাতাড়ি কাদা ছুড়তে থাকেন বাঘের চোখের দিকে। চোখে কাদা যাওয়ায় বাঘটি কামালকে ছেড়ে জঙ্গলে চলে যায়। সেদিন আহত অবস্থায় কামালকে তুলে নিয়ে গ্রামে ফিরেছিলেন। পরে পরিবারের লোকেরা তাঁকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কয়েক দিন চিকিৎসার পর কামালের চেতনা ফিরে।

কামাল হোসেন বলেন, ‘আমি কথা বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাঘটি আমার মুখে আরেকটি থাবা বসিয়ে দেয়। মুহূর্তেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় আমার বাঁ চোখ ও চোয়াল। সবকিছু সামলে নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাঘের চোখের ওপর নিজের চোখ রেখে দুই হাত দিয়ে বাঘের গলা চেপে ধরি। সঙ্গী রুহুল আমিন সরদার তখন খালের কাদামাটি দুই হাত দিয়ে তুলে ছুড়ে মারতে থাকেন বাঘটির দিকে। সম্ভবত সেই কাদামাটি বাঘের চোখে গিয়েছিল। তাই আমাকে ফেলে রেখে চলে যায় বাঘ। তখন আমার আর জ্ঞান ছিল না। পরে সঙ্গী রুহুল আমিন আমাকে উদ্ধার করেন।’

রুহুল আমিনের আছে বেঁচে থাকার লড়াই। তিনিও আগের পেশাতেই আছেন। রুহুল বলেন, হিংস্র জন্তুর ভয়ে ঘরে বসে থাকলে যে পেট ভরবে না। পেটের জ্বালা যে বড় জ্বালা। বাঘের ভয়ের চেয়ে খিদে মেটানোর জ্বালা বড়।

কামাল হোসেন বলেন, সে দিনের কথা মনে পড়লে আজও তাঁর গা শিউরে ওঠে। বাঘের আক্রমণে তাঁর মাথায় ও মুখে অগণিত ক্ষত। ফলে তাঁর চেহারায়ও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম দিকে মানুষ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে খারাপ লাগত। তবে এখন আর খারাপ লাগে না। এখন সবাই তাঁকে ডাকেন ‘টাইগার কামাল’ বলে। নামটা তাঁর বেশ ভালো লাগে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Popular Post

মতলবে ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ, হাসপাতাল অবরুদ্ধ

বাঘের মুখ থেকে ফিরে এসে ১১ বছর পর আগের পেশাতেই ‘টাইগার কামাল’

Update Time : ০৫:৩৭:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

ত্রিনদী অনলাইন নিউজ ডেস্ক :

খুলনার কয়রা উপজেলার ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের কামাল হোসেনকে সবাই ‘টাইগার কামাল’ বলে ডাকেন। সুন্দরবনে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ফিরে আসায় তাঁর এই নাম ছড়ায়। বাঘের মুখে পড়ার সেই ভয়ংকর ঘটনাটি কামালের জীবনে ঘটেছিল ১১ বছর আগে।

সাহস নিয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে ও ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে ফিরলেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন কামাল। তারপর দীর্ঘ চিকিৎসায় একসময় সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে জীবিকার তাগিদে সেই কামালকে সুন্দরবনে মাছ ধরার পেশাতেই ফিরে যেতে হয়েছে।

কামাল হোসেন বলেন, সুস্থ হয়ে আর সুন্দরবন যাবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে ভাগ্যের টানে আবারও সেই সুন্দরবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, বনের কাজে তাঁর কোনো ক্লান্তি আসে না। বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে এখন সুন্দরবন থেকে মাছ, কাঁকড়া, মধু আহরণ করেন। কখনো একা, আবার কখনো দল বেঁধে বনে যান।

গত সোমবার ৪ নম্বর কয়রা এলাকায় কামাল হোসেনের সঙ্গে দেখা হয়। সুন্দরবনে বাঘের মুখ থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা জানান তিনি। কামাল হোসেন বলেন, সুন্দরবন ঘিরেই তাঁর বেড়ে ওঠা, জীবন–জীবিকা। ২০১১ সালে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে একদিন বেলা একটার দিকে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রুহুল আমিন সরদার নামের একজন। বনের গোড়াচালকি খালে মাছ ধরছিলেন তাঁরা। হঠাৎ উৎকট গন্ধ নাকে এসে লাগে।

মাথা উঁচু করে খালপাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন একটি বাঘ পলকহীন চোখে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। কিছু বোঝার আগেই ঝোপের মধ্য থেকে বাঘটি তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চিত হয়ে খালের ভেতর কাদায় পড়ে যান। প্রথমে বাঘটি তাঁর মাথার বাঁ পাশে থাবা দিয়ে ছিলে ফেলে। প্রায় ২০ মিনিট বাঘটি তাঁর পেটের ওপর বসে থাকে। তখনো তাঁর চেতনা ছিল। হঠাৎ তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে চিৎকার, ‘বাঁচাও…’।

কামাল হোসেনের সঙ্গী রুহুল আমিন সরদার এখনো পুরোদস্তুর বনজীবী। চোখের সামনে ভয়ংকর সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রুহুল আমিন সরদার বলেন, জঙ্গল থেকে বাঘ বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে কামালের ওপর। দূর থেকে কামালের মাথায় রক্তক্ষরণ দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন কামাল মারা গেছে।

তারপর যখন কামাল হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে তখন এলোপাতাড়ি কাদা ছুড়তে থাকেন বাঘের চোখের দিকে। চোখে কাদা যাওয়ায় বাঘটি কামালকে ছেড়ে জঙ্গলে চলে যায়। সেদিন আহত অবস্থায় কামালকে তুলে নিয়ে গ্রামে ফিরেছিলেন। পরে পরিবারের লোকেরা তাঁকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কয়েক দিন চিকিৎসার পর কামালের চেতনা ফিরে।

কামাল হোসেন বলেন, ‘আমি কথা বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাঘটি আমার মুখে আরেকটি থাবা বসিয়ে দেয়। মুহূর্তেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় আমার বাঁ চোখ ও চোয়াল। সবকিছু সামলে নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাঘের চোখের ওপর নিজের চোখ রেখে দুই হাত দিয়ে বাঘের গলা চেপে ধরি। সঙ্গী রুহুল আমিন সরদার তখন খালের কাদামাটি দুই হাত দিয়ে তুলে ছুড়ে মারতে থাকেন বাঘটির দিকে। সম্ভবত সেই কাদামাটি বাঘের চোখে গিয়েছিল। তাই আমাকে ফেলে রেখে চলে যায় বাঘ। তখন আমার আর জ্ঞান ছিল না। পরে সঙ্গী রুহুল আমিন আমাকে উদ্ধার করেন।’

রুহুল আমিনের আছে বেঁচে থাকার লড়াই। তিনিও আগের পেশাতেই আছেন। রুহুল বলেন, হিংস্র জন্তুর ভয়ে ঘরে বসে থাকলে যে পেট ভরবে না। পেটের জ্বালা যে বড় জ্বালা। বাঘের ভয়ের চেয়ে খিদে মেটানোর জ্বালা বড়।

কামাল হোসেন বলেন, সে দিনের কথা মনে পড়লে আজও তাঁর গা শিউরে ওঠে। বাঘের আক্রমণে তাঁর মাথায় ও মুখে অগণিত ক্ষত। ফলে তাঁর চেহারায়ও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম দিকে মানুষ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে খারাপ লাগত। তবে এখন আর খারাপ লাগে না। এখন সবাই তাঁকে ডাকেন ‘টাইগার কামাল’ বলে। নামটা তাঁর বেশ ভালো লাগে।