পার্থিবে মৃত্যু অবধারিত। আজ হোক কিংবা কাল, জীবনের ভাগে যার আয়ু মিলবে মৃত্যু তাকে গিলবেই। মৃত্যু তার জন্য প্রস্তুত, সুযোগ পেলেই হন্তদন্ত হয়ে হায়াতের সবটুকু চেটেপুটে নিবে। যদিও মৃত্যু পাহাড়সম কষ্ট কিংবা পৃথিবীসম যন্ত্রণার! তবুও কিছু করার নেই। এতে মুক্তিলাভের কোন সুযোগ নেই। তবে কিছু মৃত্যু আছে মেনে নেওয়া ভীষণ কষ্টের। যা অবিশ্বাস্য। তেমনি আমাদের প্রিয় একজন অভিভাবক আমরা হারিয়েছি! মুখে রাসুলের (সাঃ) সুন্নত নিয়ে যার বাঁকা ঠোঁটে সদা এক চিমটি হাসি লেপ্টে থাকতো। যিনি ছিলেন মিষ্টভাষী। মাদ্রাসার ক্যাম্পাসে যিনি একজন অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। তিনি স্টুডেন্টদের কল্যাণে কখনও দাঁতে দাঁত পিষে অগ্নীশর্মা হতেন আবার কখনও কখনও পুরোদস্তুর বন্ধুর স্বভাবে মুগ্ধতা ছড়াতেন। আজ আমাদের শত শব্দের কলরব ছেড়ে স্যার বহুদূর গিয়ে এক নির্জনে ঠাঁই নিয়েছেন।
বলছিলাম রামচন্দ্রপুর মাদ্রাসার বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব মরহুম জসিম উদ্দিন স্যারের কথা, গত ১৬ ফেব্রুয়ারী, শুক্রবার জসিম স্যার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে, না ফেরার দেশে চলে গেলেন। রামচন্দ্রপুর মাদ্রাসায় অনুজ অগ্রজ সকল স্টুডেন্টদের কাছে যার জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশছোঁয়া। শিক্ষক হিসেবে যিনি ছিলেন প্রকৃত মানুষ গড়ার কারিগর। রামচন্দ্রপুর মাদ্রাসায় শিক্ষাদানে যার অবদান অনস্বীকার্য। স্যারের কথা বলতে গেলে কলমে কাগজে তার সৌন্দর্যের যথার্থতা তুলে ধরা সম্ভব নয়, একজন বাংলা প্রভাষক হিসেবে যিনি ছিলেন কিংবদন্তি শিক্ষক। আমার ছাত্র জীবনে স্যারের প্রতিটা ক্লাসই খুব স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে অনুধাবন করতে বাধ্য হয়েছি। বাংলা ব্যাকরণ ও সাহিত্য পাঠদানে যিনি অনন্য। একজন বাংলা শিক্ষক হিসেবে পাঠদানের পাশাপাশি যোগ্যতার আদলে যতগুলো বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, তার সবকটি স্যারের ছিলো। স্যার প্রতিদিনের পাঠদান পূর্বে বাসা থেকে প্রস্তুত করে আসতেন এবং ডায়েরি ম্যান্টেন করতে একদমই ভুলতেন না। বাংলা সাহিত্য কিংবা ব্যাকরণে যিনি ছিলেন প্রাণচচঁল। প্রতিটা লাইন বাই লাইন ভেঙে ভেঙে না পড়ালে যেন তিনার পেটের ভাত হজম হত না! ক্লাসের কাজে অথবা স্টুডেন্টদের হক আদায়ে স্যার সদা ছিলেন অনড়। তিনি যখন যা পড়াতেন, তা অনুযায়ী নিজকে গুলিয়ে নিতেন।
স্যার ক্লাসে প্রবেশ করলে পুরো ক্লাসজুড়ে পিনপতন নীরবতা বয়ে যেত। সকলের মাঝে একটা উদগ্রীবতা বিরাজ করতো স্যারের পাঠদানের অপেক্ষায়। যিনি ছিলেন একজন যাদুকরের মত, যখনই পাঠদান দিতেন সবাই স্যারের দিকে তন্ময় চোখে এক নিমিষে তাকিয়ে থাকতেন। স্টুডেন্টদের বুঝার সুবিধার্থে সাহিত্য পাঠদানকালে প্রতিটা গদ্য, পদ্যের চরিত্রে নিজকে ঐরকমভাবে সাজিয়ে নিতেন, যা ছিলো স্যারের শিক্ষকতার অনন্য বৈশিষ্ট্য। কিছু কিছু বিশেষ মুহুর্তে, যেমন ঋতুরাজ বসন্তকালের জন্য স্যার দারুণ কিছু গদ্য, পদ্য রেখে দিতেন এবং আমাদের মাধ্যমে মফস্বলের অবহেলা, অনাদরে বেড়ে উঠা ছিন্নমূল ফুল কুড়াতেন। এভাবে স্যারের কথামতো আমরা সবাই যার যার বাড়ির আশপাশ থেকে ফুল কুড়িয়ে আনতাম। কেউ জারুল ফুল, কেউবা আনতো ভাঁট ফুল। কেউ আনতো বদ্ধ জলাশয়ের রাশি রাশি ফুটন্ত কচুরিপানা। কেউ কেউ নিয়ে আসতো রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া, কেউ কুড়াতো কুমড়ার ফুল, কারো হাতে এসেছে বুনোফুল, কেউ এনেছেন কদম ফুল, একজন এনেছে শিমগাছের ফুল এরকমভাবে সবাই যখন এক এক করে ক্লাসে ফুল নিয়ে আসতো এবং যার যার ফুলগুলো সামনে রাখতো, তখন পুরো ক্লাসজুড়ে যেন এক অন্যরকম শ্বেত শুভ্রতার হিল্লোল বয়ে যেত। সেদিন ডিপার্টমেন্টের করিডরে ছোটখাটো একটা ফুল উৎসব হয়ে যেত। এভাবেই স্যার আমাদের আনন্দের মধ্য দিয়ে পাঠদান দিতেন। যার দরুন শিক্ষার্থী ও পুরো ক্লাস জুড়ে এক অন্যরকম আনন্দ, উপভোগ বিরাজ করতো। সাথে সাথে প্রতিটা শিক্ষার্থীই স্যারের পাঠদান সহজে আয়ত্ত করতে সক্ষম হত। পাঠগ্রহণে কারো মধ্যে কোনরূপ দুরন্তপনা কাজ করতো না।
স্যার, একজন জেনারেল শিক্ষিত মানুষ হলেও চলনে বলনে নিরেট মুসলিম ধর্মভীরু ছিলেন। ধর্ম পালনে কমতি ছিলো না, বরং যতটুকু পারতেন ইসলাম জানতে শিখতে নিজকে মনোনিবেশ করতেন। বিশেষ করে নবী করিম সা: এর সুন্নতের প্রতি প্রভিষ্ট ছিলেন। লেবাসে শার্ট প্যান্ট থাকলেও তিনি তা পরিধানে সতর মেনে চলতেন। তিনি ভুল করেও কখনো টাখনুর নিচে প্যান্ট পড়তেন না। আসা যাওয়ায় মুখে সর্বদা সালাম লেগে থাকতো। হাঁটা চলায় যথেষ্ট নমনীয়তা ছিলেন, স্যার যখন হাটতেন সামনের দিকে মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিতেন। চলার পথে চক্ষু অবনত রাখতেন। তিনি সদা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কখনো অন্যায়ের কাছে মাথানত করতেন না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বদা বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ছিলেন এবং সর্বদা জিহাদি মনোভাব নিয়ে চলাফেরা করতেন। তিনি আমাদের বলতেন “আমি সর্বক্ষণ প্রস্তুত! যখনই ডাক আসবে সবার আগে আমাকে পাবে”। যার ভিতরে দুনিয়ার কোন মোহ ছিলো না।
মৃত্যুকালে স্যারের জানাযায় উপস্থিত হয়ে আরও অজানা বিস্ময়কর কথার স্বাক্ষী হলাম। জানাযায় স্যারের বাড়ির মাদ্রাসার মুহতামিম কান্নাজড়িত কন্ঠে সবার সামনে প্রিয় স্যারের কিছু স্মৃতি তুলে ধরলেন। স্যারের নাকি মোবাইল লক ছিলো ৫৭০ সংখ্যা দিয়ে যা হযরত মোহাম্মদ সা. এর জন্মদিনের সাল। এবং স্যার একজন সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যাবসায়ী হয়েও দুনিয়া বিমুখ ছিলেন যার নাকি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন কাপড় ছিলো না। ২-৩টা পোষাকেই ওনি জীবন পরিচালনা করতেন। এবং ওনার স্ত্রী সন্তানদেরও সেম পোষাক কিনে দিতেন। কেবল এই নয়, স্যার পুরোদস্তুর একজন পরোপকারী ছিলেন, যিনি শতবারেরও বেশি রক্তদান করেছেন। এবং নিজের বাড়িতে একটি মাদ্রাসাও করে গেছেন, যার জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।
সবমিলিয়ে স্যার ছিলেন একজন অনবদ্য মানুষ, শিক্ষক হিসেবে যার দিকনির্দেশনা, শিক্ষাদানের পদ্ধতি, স্নেহ-ভালোবাসা মনে আলাদা করে দাগ কাটে। প্রয়াত জসিম স্যার জীবন থেকে ছুটি নিলেও আমাদের অন্তরে সদা বেঁচে থাকবেন স্বমহিমায়। অধ্যাপক জসিম স্যার ব্রেইন স্টোক করে ঢাকার ধানমন্ডি পপুলার হাসপাতালে আই সি ইউ তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত অনুমান ১১ টায় ইন্তেকাল করেন। প্রিয় শিক্ষকের আকস্মিক মৃত্যুতে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত উনার হাজারো শিক্ষার্থী, শুভাকাঙ্ক্ষীরা সেদিন শোকে মুহ্যমান ছিলেন।
রামচন্দ্রপুর ফাজিল মাদ্রাসার প্রতিটা করিডোরে স্যারের আর সেই সদর্পে বিচরণ থাকবে না। ক্লাসে দুষ্টামির জন্য শাণিত কণ্ঠে আর আওয়াজ শুনা যাবে না। জীবনমুখী উপদেশগুলো আর শোনা হবে না কোনোদিন। যিনি তার শিক্ষকতা জীবনে তার ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। তাঁর মতো নিঃস্বার্থ, নিবেদিতপ্রাণ জ্ঞানের ভাণ্ডারসমৃদ্ধ শিক্ষক যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করেন না। রামচন্দ্রপুর মাদ্রাসা যাকে হারিয়েছে তার শূন্যত্য অপূরণীয়। রামচন্দ্রপুর মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের ভাগ্য খারাপ। এরকম শিক্ষক আর ৫০ বছরেও পাবে না তারা। এক জসিম স্যারের মৃত্যুতে একাডেমিকভাবে রামচন্দ্রপুর মাদ্রাসার একটি শক্ত খুঁটি ভেঙে গেছে।
সর্বোপরি, এটিই বাস্তব যে, জীবন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলে সবাইকে ভাবতে হয় তার অতীত জীবনের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়ে। কেন তিনি এসেছেন এ পৃথিবীতে। আর কতটাই বা সফল হয়েছে তার এই আগমনের উদ্দেশ্য? যুগে যুগে অনেক মনীষী এসেছেন এ ধরিত্রীকে আলোকিত করতে। তেমনি এক জাগ্রত বিবেকের মানুষ ছিলেন অধ্যাপক জসিম স্যার।স্বচ্ছ দায়িত্ববোধ, সুন্দর আচরণ, উত্তম আদর্শ, আর উন্নত ব্যক্তিত্বের মধ্যেই নিহিত ছিল তাঁর মহত্ব এবং কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন, অ্যাকাডেমিক অসততা করলে রব্বে কারীমের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। তিনি কখনো কোনো ক্লাসে এক মিনিট দেরি করে গেছেন অথবা অ্যাকাডেমিক অন্য কাজে সামান্যতম গাফিলতি করেছেন এমনটা দেখিনি। আমাদের সবসময় তিনি শিখিয়েছিলেন সময়ের কাজ সময়ে না করতে পারাটা এক ধরনের অন্যায়।
স্যারের মৃত্যুতে আজ অবধিও মনটার মধ্যে বেশ শূন্যতা ও বিষন্নতা অনুভব করি। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, আচার-ব্যবহার, সফলতায় অসংখ্য শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি নিঃসন্দেহে একজন আইডল ছিলেন। ক্লাসরুম এবং ক্লাসরুমের বাইরে স্যার শিক্ষার্থীদের কাছে অসাধারণ একজন অভিভাবক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে বিদায়বেলায় স্যারকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবেগঘন হাজারো স্ট্যাটাস, অশ্রুসিক্ত আহাজারি, সহকর্মীদের ভগ্নহৃদয়ের স্মৃতিচারণ এসবই জানান দিয়েছিল কতটা আদর্শ শিক্ষক ছিলেন তিনি। এইদিক থেকে পৃথিবীতে তাঁর আগমন সার্থক। আমার সামান্য শিক্ষাজীবনে অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরুর স্নেহে ধন্য হয়েছি। তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর স্নেহে জীবনকে ভরিয়েছি। কিছু কিছু সম্পর্ক সময়ের পরিক্রমায় ফিকে হয়ে যায় আবার কিছু কিছু সম্পর্ক আজীবন মনের আকাশে উজ্জ্বল থেকে স্মৃতির মনিকোঠায় আলো ছড়ায়। জসিম স্যারের সঙ্গে আমার তেমনই এক স্নেহময় আত্মিক সম্পর্ক, যা শুধু মাদ্রাসা জীবনের চারদেয়ালে আটকে ছিল না বরং তার পরশ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। আমি ব্যাক্তিগতভাবে স্যারকে অনেক বিরক্ত করেছি, আমি সাংস্কৃতিক মানুষ হিসেবে যখনই কোন গান লিখতাম স্যারকে উপস্থাপন করতাম। লিরিকের সুর, ছন্দ নিয়ে স্যারের সাথে আলোচনা করতাম। যেকোন শব্দ কিংবা ছন্দ নিয়ে দারস্থ হতাম স্যারের নিকটে।
রামচন্দ্রপুর মাদ্রাসায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর জন্য স্যার আমাকে পারফর্মের জন্য বেঁচে নিতেন। ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে তো স্যার আমাকে দিয়েই পুরো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করিয়েছেন। এভাবে মাদ্রাসায় অধ্যায়নকালে স্যারের স্নেহ মমতার পরশে আটকা ছিলাম। শুধু কেবল আমিই নয় এরকম সকল স্টুডেন্টরাই স্যারের কাছ থেকে দুহাত ভরে স্নেহ পেত অফুরান। স্যার বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল তার হাজার হাজার প্রিয় ছাত্রদের মনে, যাদেরকে তিনি শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে গেছেন। নিজেকে নিবেদিত করেছেন মানুষের মাঝে মনুষ্যত্বকে বিকশিত করার কাজে। যারা তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছেন তারাই কেবল অনুধাবন করতে পেরেছেন। আল্লাহ স্যারের পরিবারকে ধৈর্য্য ধারনের শক্তি দিন এবং স্যারের সন্তানদের নিরাপদ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দিন।পরপারে মহান আল্লাহ যেন আমাদের প্রিয় স্যারকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করেন এই দোয়া করি। আমিন।
আক্তার হোসেন আকন
পরীক্ষার্থী (ফাজিল তৃতীয় বর্ষ)
রামচন্দ্রপুর কাসেমিয়া সিদ্দিকিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা
হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।