বাঁশ। বাংলাদেশে এই শব্দটাই বেশ সংবেদনশীল এবং নেতিবাচক উপমায় ব্যবহার হয়। তবে আপনি কি জানেন এই বাঁশ পরিবেশ রক্ষায় কতোটা ভূমিকা রাখছে? এর অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য উপকারিতা কতোটা?
টমাস আলভা এডিসন যে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেছিলেন সেটার মধ্যেও কিন্তু বাঁশের ফিলামেন্ট ব্যবহার করা হয়েছিল। জেনে নিন বাঁশের এমন নানা উপকারিতার কথা।
বাঁশ কোনো গাছ নয়। এটি মূলত এক ধরণের ঘাস এবং চীর সবুজ বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ যা নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে জন্মায়।
পৃথিবীতে ৩০০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউট ৩৩ প্রজাতির বাঁশ সংরক্ষণ করেছে। এরমধ্যে রয়েছে— মুলি, তল্লা, আইক্কা, ছড়িসহ নানা প্রজাতির বাঁশ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বাঁশের প্রজাতি ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে, প্রথম স্থানে আছে চীন।
চীনের সভ্যতায় বাঁশকে শুভশক্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। একারণে চীনা সংস্কৃতির সর্বত্র রয়েছে বাঁশের ব্যবহার। তারা মনে করে বাঁশ নেগেটিভ এনার্জিকে প্রতিহত করতে পারে।
খাদ্য হিসেবেও বাঁশ ব্যবহৃত হচ্ছে। পুষ্টি উপাদান ও মুখরোচক স্বাদের জন্য পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের কাছে খাবার বাঁশ কোড়ল নামে পরিচিত।
এর তৈরি স্যুপ, সালাদ, তরকারি বেশ জনপ্রিয়। সাধারণত বাঁশের অঙ্কুরোদগম হওয়ার পর চার থেকে ছয় ইঞ্চি পর্যন্ত যে কচি বাঁশ হয় সেটাই রান্না করে খাওয়া যায়।
আবার বাঁশ পাতা দুধ টাটকা রাখতে এবং চায়ের মধ্যে দিয়েও খাওয়া যায়। পুষ্টিবিদরা জানিয়েছেন, রান্না করা বাঁশে ফাইবার, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, পটাসিয়াম, ভিটামিন ই, আয়রন পাওয়া যায় যা শরীরকে চাঙ্গা রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ করে।
খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে বাঁশ হার্টের জন্য ভালো। ফাইবার থাকায় এটি কোষ্ঠকাঠিন্যে উপশম দেয় এবং হজমশক্তি বাড়ায়।
এটি খাওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা লাগে না ফলে ওজন কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে বাঁশ কাঁচা বা বাসি অবস্থায় খাওয়া যাবে না কারণ এতে পেটে সমস্যা হতে পারে।
বাঁশের কোড়ল সূর্যালোক থেকে দূরে ঠান্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে। আবার বাঁশের পাতা উত্তম গোখাদ্য।
প্রকৃতি-পরিবেশ ও প্রাণ রক্ষায় বিশেষ করে, দুর্যোগ মোকাবেলা, পাহাড় ধস, ভূমি ক্ষয়, নদী ভাঙ্গন রোধসহ জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় বাঁশের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না।
ওয়ার্ল্ড ব্যাম্বু অর্গানাইজেশনের তথ্যমতে, বাঁশ অন্যান্য গাছগাছালির চেয়ে বেশি অক্সিজেন উৎপাদন করে আর বেশি মাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে।
ফলে বাতাস বিশুদ্ধ থাকে। বলা হয় বাঁশঝাড় আশেপাশের তাপমাত্রাকে চার ডিগ্রি পর্যন্ত ঠান্ডা রাখতে সক্ষম।
ফলে এটা অনেকটা প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনার হিসাবে কাজ করে। এছাড়া তীব্র রোদ থেকে লম্বা লম্বা বাঁশঝাড় ছায়াও দিয়ে রাখে।
বাঁশ গাছের শেকড় ছড়ানো থাকায় এটি মাটি ভাঙন রোধ করে, মাটির ঢালকে মজবুত করে, ফলে পাহাড় ধস ঠেকানো যায়, ভারী ধাতু শোষণ করে মাটির ক্ষয় রোধ করে, বিভিন্ন বন্যপ্রাণী আশ্রয় নিতে পারে। এক কথায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ঠেকাতে বাঁশের গুরুত্ব রয়েছে।
বাংলাদেশে বছরে শুকনো বাঁশের চাহিদা অন্তত ১০ লাখ টন।
এরমধ্যে নির্মাণকাজে সবচেয়ে বেশি বাঁশের প্রয়োজন। চাহিদা থাকায় চাঁদপুর, সিলেট ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলায় বাঁশের বাণিজ্যিক আবাদ হচ্ছে।
বাংলাদেশের গ্রামে উন্নত বাড়িঘর নির্মাণে বাঁশ বেশ টেকসই উপাদান। বিশেষ করে কাঁচা বাড়ির ভিত দেয়াল ও ছাদ তৈরিতে বাঁশের পাটাতন ও ফ্রেম ব্যবহার হয়।
বাঁশের পাতায় ঘরের ছাউনি হয়। আবার পাহাড়ি এলাকায় বাঁশ দিয়েই তোলা হয় মাচার ঘর।
গ্রামের লোকজন ছোট খাল পার হতে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁশ দিয়ে সেতু বানিয়ে থাকেন। কারণ অল্প টাকায় এর চাইতে মজবুত ও টেকসই সেতু গড়া সম্ভব না।
এছাড়া বেড়া তুলতে বা বন্যার সময় আশ্রয়ের জন্য মজবুত মাচা তুলতেও বাঁশ লাগে।
ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকেও বসত-ঘরকে রক্ষা করে বাঁশ। এ কারণে গ্রামে বসতবাড়ির পাশে বাঁশঝাড় দেখা যায়।
জাপানে প্রচুর বাঁশের ঘর দেখা যায়। কারণ এসব ঘর ভূমিকম্প সহনীয়। ভূমিকম্পের সময় বাঁশঝাড়ে আশ্রয় নেয়া সবচেয়ে নিরাপদ।
সুতা ও কাগজ তৈরিতে বাঁশের ব্যবহার অনেক আগে থেকে হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বাঁশের তন্তু দিয়ে টুপি, স্কার্ফ, গ্লাভস, মোজা ও প্যান্ট তৈরি হচ্ছে।
সেইসাথে বিভিন্ন ধরণের কাগজ, টয়লেট পেপার তৈরিতেও ব্যবহার হচ্ছে বাঁশ।
নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্য: আসবাবপত্র, বাদ্যযন্ত্র, রান্নাঘরের বিভিন্ন সরঞ্জাম যেমন কুলো, ডালা, ঝুড়ি, চাঁটাই, প্লেট, বাটি, চামচ, স্ট্র সেইসাথে কৃষি সরঞ্জাম, তোরণ, প্যান্ডেল তৈরি, ল্যাম্প, জামাকাপড়ের হ্যাঙ্গার, ল্যাপটপের কেসিং, ইত্যাদি নানা ধরণের পণ্য বানাতে বাঁশ দরকার হয়।
বাঁশের তৈরি হস্তশিল্প পরিবেশবান্ধব, যা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। এগুলো সাধারণত দামে সস্তা হয় আবার রপ্তানি করে আয়ের সুযোগও থাকে।
বাঁশের মধ্যে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ থাকায় এটি এখন শ্যাম্পু, ক্রিমসহ নানা ধরণের প্রসাধনীসহ পোকামাকড় প্রতিরোধকের মতো পণ্য তৈরিতেও ব্যবহার হচ্ছে।
এতো উপকারী এই উদ্ভিদের বিশেষ কোনো যত্নের প্রয়োজন হয় না। এটি যেকোনো পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে মাঝে মধ্যে পানি দিলেই হয়।
বাঁশ খুব দ্রুত বড় হয়। চারা রোপণের পর পাঁচ বছরেই পূর্ণাঙ্গ বাগানে পরিণত হয়। বাঁশ গাছ সাধারণত একত্রে গুচ্ছ হিসেবে জন্মায়। এক একটি গুচ্ছে ১০- ৮০ টি বাঁশ গাছ থাকতে পারে। এসব গুচ্ছকে বাঁশঝাড় বলে।
কিছু প্রজাতির বাঁশ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৩৬ ইঞ্চি বৃদ্ধি পায়। এর মানে প্রতি ৪০ মিনিটে প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ বড় হয়। তাই বাঁশ যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। নিয়মিত কেটে পরিষ্কার করতে হবে।
দ্রুত বাড়ার কারণে বাঁশঝাড় বিক্রি করে ভালো উপার্জনের সুযোগ থাকে । অনেকে আবার বাড়ির ভেতরের বাতাস বিশুদ্ধ রাখতে বাঁশের চারা লাগিয়ে থাকেন।
চাইলে এটি বাগানের মাটিতে রোপণ করা যেতে পারে বা একটি পাত্রে সাজানো যেতে পারে। কিছু প্রজাতির বাঁশ গাছ শুধু পানিতে রাখলেই হয়। (বিবিসি)