ঢাকা 11:41 pm, Sunday, 17 August 2025

পারিবারিক লড়াইয়ের জেরে ১২ বছরেও দাফন হয়নি ব্রিটিশ ধনকুবেরের

গত সপ্তাহেই কেনিয়ার আদালতের এক ম্যাজিস্ট্রেট আশা প্রকাশ করেছেন, ব্রিটিশ সম্পদশালী ব্যবসায়ী হ্যারি রয় ভিভার্সের আত্মা এবার হয়তো শান্তি পাবে। কিন্তু মৃত্যুর ১২ বছর পরও তাঁর মরদেহ কোথায় শায়িত হবে—সে প্রশ্ন এখনো অনির্ধারিতই রয়ে গেছে।

২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডেতে কেনিয়ার মোম্বাসার নিজ বাড়িতে মারা যান ৬৪ বছর বয়সী ভিভার্স। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া, পারিবারিক দ্বন্দ্ব আর হত্যার অভিযোগের জটিলতায় তাঁর মরদেহ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মর্গে পড়ে রয়েছে।

আজ রোববার (১৭ আগস্ট) বিবিসি জানিয়েছে, ভিভার্সের মৃত্যুর পরই চার সন্তানের মধ্যে বিভাজন শুরু হয়। প্রথম স্ত্রীর দুই ছেলে রিচার্ড ও ফিলিপ একদিকে, আর দ্বিতীয় স্ত্রী আজরা পারভিন দিন ও তাঁদের দুই মেয়ে হেলেন ও আলেক্সান্দ্রা অন্যদিকে অবস্থান নেন। ছেলেদের অভিযোগ, তাঁদের বাবাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যে। তবে মেয়েরা ও তাঁদের মা এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন।

কেনিয়ার আদালতে শুনানির সময় পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয় যে, কখনো কখনো দুই পক্ষের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচিও ঘটে। একপর্যায়ে দুই বোনকে আদালত কক্ষে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে সতর্কও করা হয়।

জানা যায়, কেনিয়ায় স্বামীর মৃত্যুর পর আজরা পারভিন দিন দ্রুত ইসলামি নিয়মে ভিভার্সকে দাফন করেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যে থাকা ভিভার্সের প্রথম স্ত্রীর দুই ছেলে এতে আপত্তি তোলেন। তাঁদের দাবি, বাবা খ্রিষ্টান ছিলেন, মুসলিম নন। এমনকি ভিভার্সকে ভিন্ন নামে সমাহিত করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি ছেলেদের সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

ছেলেদের বক্তব্য, বাবার দেহে লালচে দাগ ও ঠোঁটে অস্বাভাবিক বেগুনি রং দেখা যাচ্ছিল। তাই তাঁরা ময়নাতদন্ত চেয়েছিলেন। কিন্তু পারভিন দিন তা করতে দেননি এবং মৃত্যুর খবর পুলিশকেও জানাননি। আদালত পরে মন্তব্য করে যে, এ সিদ্ধান্তই পরবর্তী সন্দেহ ও পারিবারিক সংঘাতের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ছেলেদের আবেদনের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের এপ্রিলে মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দেওয়া হলেও আসলে তা সম্পন্ন হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। তত দিনে দেহ প্রায় পচে যায়। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞেরা ভিন্ন ভিন্ন মত দেন। কেউ কেউ দেহ ও কবরস্থ মাটিতে বিষাক্ত রাসায়নিক ‘সাইহ্যালোথ্রিন’ খুঁজে পান, আবার অন্যরা কোনো প্রমাণ পাননি। এই অসামঞ্জস্য আদালতের সিদ্ধান্তকে আরও জটিল করে তোলে।

অবশেষে মোম্বাসার আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ডেভিড ওধিয়াম্বো রায়ে জানান, মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ধারণ সম্ভব নয়। পচন ধরার কারণে দেহ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি। তাই কাউকে দায়ী করার সুযোগও নেই।

রায়ের পর আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, মরদেহ পরিবারকে ফেরত দেওয়া হবে এবং তারা যেখানে চাইবে, সেখানে পুনরায় দাফন করতে পারবে। কিন্তু এখানেই নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে। ছেলেদের দাবি, তাঁদের বাবা ব্রিটিশ। তাই তাঁকে যুক্তরাজ্যেই দাফন করা উচিত। অন্যদিকে দ্বিতীয় স্ত্রী ও মেয়েরা চান, কেনিয়ার মোম্বাসাতেই তাঁর সমাধি হোক।

যেহেতু ভিভার্স কোনো উইল রেখে যাননি এবং নির্দিষ্ট ধর্মীয় বা সামাজিক রীতিও স্পষ্টভাবে মানতেন না, তাই আদালত সরাসরি সিদ্ধান্ত না দিয়ে পক্ষগুলোকে অন্য আইনি প্রক্রিয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

পুরো ঘটনায় একটি বিষয় স্পষ্ট—ভিভার্সের মৃত্যু পরিবারকে আরও কাছাকাছি না এনে উল্টো গভীরভাবে বিভক্ত করেছে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিচারকও। তাই আদালত পরিবারকে সিদ্ধান্ত নিতে বললেও ভিভার্সের মরদেহ আর কত দিন হিমঘরে থাকবে, তা অজানাই রয়ে গেল।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

Popular Post

হাজীগঞ্জে পানিতে ডুবে দুই বছর বয়সি শিশুর মৃত্যু

পারিবারিক লড়াইয়ের জেরে ১২ বছরেও দাফন হয়নি ব্রিটিশ ধনকুবেরের

Update Time : 11:03:48 pm, Sunday, 17 August 2025

গত সপ্তাহেই কেনিয়ার আদালতের এক ম্যাজিস্ট্রেট আশা প্রকাশ করেছেন, ব্রিটিশ সম্পদশালী ব্যবসায়ী হ্যারি রয় ভিভার্সের আত্মা এবার হয়তো শান্তি পাবে। কিন্তু মৃত্যুর ১২ বছর পরও তাঁর মরদেহ কোথায় শায়িত হবে—সে প্রশ্ন এখনো অনির্ধারিতই রয়ে গেছে।

২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডেতে কেনিয়ার মোম্বাসার নিজ বাড়িতে মারা যান ৬৪ বছর বয়সী ভিভার্স। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া, পারিবারিক দ্বন্দ্ব আর হত্যার অভিযোগের জটিলতায় তাঁর মরদেহ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মর্গে পড়ে রয়েছে।

আজ রোববার (১৭ আগস্ট) বিবিসি জানিয়েছে, ভিভার্সের মৃত্যুর পরই চার সন্তানের মধ্যে বিভাজন শুরু হয়। প্রথম স্ত্রীর দুই ছেলে রিচার্ড ও ফিলিপ একদিকে, আর দ্বিতীয় স্ত্রী আজরা পারভিন দিন ও তাঁদের দুই মেয়ে হেলেন ও আলেক্সান্দ্রা অন্যদিকে অবস্থান নেন। ছেলেদের অভিযোগ, তাঁদের বাবাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যে। তবে মেয়েরা ও তাঁদের মা এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন।

কেনিয়ার আদালতে শুনানির সময় পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয় যে, কখনো কখনো দুই পক্ষের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচিও ঘটে। একপর্যায়ে দুই বোনকে আদালত কক্ষে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে সতর্কও করা হয়।

জানা যায়, কেনিয়ায় স্বামীর মৃত্যুর পর আজরা পারভিন দিন দ্রুত ইসলামি নিয়মে ভিভার্সকে দাফন করেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যে থাকা ভিভার্সের প্রথম স্ত্রীর দুই ছেলে এতে আপত্তি তোলেন। তাঁদের দাবি, বাবা খ্রিষ্টান ছিলেন, মুসলিম নন। এমনকি ভিভার্সকে ভিন্ন নামে সমাহিত করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি ছেলেদের সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

ছেলেদের বক্তব্য, বাবার দেহে লালচে দাগ ও ঠোঁটে অস্বাভাবিক বেগুনি রং দেখা যাচ্ছিল। তাই তাঁরা ময়নাতদন্ত চেয়েছিলেন। কিন্তু পারভিন দিন তা করতে দেননি এবং মৃত্যুর খবর পুলিশকেও জানাননি। আদালত পরে মন্তব্য করে যে, এ সিদ্ধান্তই পরবর্তী সন্দেহ ও পারিবারিক সংঘাতের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ছেলেদের আবেদনের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের এপ্রিলে মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দেওয়া হলেও আসলে তা সম্পন্ন হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। তত দিনে দেহ প্রায় পচে যায়। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞেরা ভিন্ন ভিন্ন মত দেন। কেউ কেউ দেহ ও কবরস্থ মাটিতে বিষাক্ত রাসায়নিক ‘সাইহ্যালোথ্রিন’ খুঁজে পান, আবার অন্যরা কোনো প্রমাণ পাননি। এই অসামঞ্জস্য আদালতের সিদ্ধান্তকে আরও জটিল করে তোলে।

অবশেষে মোম্বাসার আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ডেভিড ওধিয়াম্বো রায়ে জানান, মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ধারণ সম্ভব নয়। পচন ধরার কারণে দেহ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি। তাই কাউকে দায়ী করার সুযোগও নেই।

রায়ের পর আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, মরদেহ পরিবারকে ফেরত দেওয়া হবে এবং তারা যেখানে চাইবে, সেখানে পুনরায় দাফন করতে পারবে। কিন্তু এখানেই নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে। ছেলেদের দাবি, তাঁদের বাবা ব্রিটিশ। তাই তাঁকে যুক্তরাজ্যেই দাফন করা উচিত। অন্যদিকে দ্বিতীয় স্ত্রী ও মেয়েরা চান, কেনিয়ার মোম্বাসাতেই তাঁর সমাধি হোক।

যেহেতু ভিভার্স কোনো উইল রেখে যাননি এবং নির্দিষ্ট ধর্মীয় বা সামাজিক রীতিও স্পষ্টভাবে মানতেন না, তাই আদালত সরাসরি সিদ্ধান্ত না দিয়ে পক্ষগুলোকে অন্য আইনি প্রক্রিয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

পুরো ঘটনায় একটি বিষয় স্পষ্ট—ভিভার্সের মৃত্যু পরিবারকে আরও কাছাকাছি না এনে উল্টো গভীরভাবে বিভক্ত করেছে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিচারকও। তাই আদালত পরিবারকে সিদ্ধান্ত নিতে বললেও ভিভার্সের মরদেহ আর কত দিন হিমঘরে থাকবে, তা অজানাই রয়ে গেল।