চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী মেহের কালিবাড়িতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শ্যামাপুজা (কালীপুজা) ও দীপাবলি উৎসব উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষাধিক পুণ্যার্থীর আগমন ঘটেছে। এই উৎসব চলমান থাকবে আগামী এক মাসব্যাপী।
দীপাবলি উৎসব উপলক্ষে সোমবার (২০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় কালিবাড়িতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন।
প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের সময় জেলা প্রশাসক বলেন, এই প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে আমরা আরও আলোকিত ও শক্তিশালী হতে পারি, এই শক্তিশালীটা ন্যায়ের দিক থেকে। এই আলোকে আমরা বলি জ্ঞানের অংশ। আলো প্রজ্জ্বলন মানে হলো আমরা জ্ঞানের দিকে ধাবিত হচ্ছি। আমরা যখন ভয় পাই তখন আলো জ্বালাই। এটা শুধু আমাদের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান নয়-সমাজকে আলোকিত ও পথ দেখানোর জন্য একটা প্রতীকী স্বরূপ এই প্রদীপ প্রজ্জ্বলন। এই উপজেলা, জেলা এবং সারা বাংলাদেশের যত মানুষ আছেন, আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করবো- এই যে জ্ঞানের, শক্তির ও সম্প্রীতির আলোটা প্রজ্জ্বলিত হলো, তা যেন নিভে না যায়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিয়া হোসেন, কচুয়া সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আঃ হাই, শাহরাস্তি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল বাসার, জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক তমাল চন্দ্র ঘোষ, উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি নিখিল মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক অমৃত দে মজুমদার টূটন প্রমুখ।
এশিয়ার বৃহত্তম কালিবাড়ি হিসেবে পরিচিত এ ধর্মীয় পীঠস্থানে দীপাবলি উৎসবে প্রতিবছর কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে পূজায় অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভক্তদের আগমন ঘটে।
সোমবার (২০ অক্টোবর) বেলা আড়াইটায় পুজার লগ্ন শুরু হয় এবং এ লগ্ন শেষ মঙ্গলবার দুপুরে। এ সময় ভক্তকুলের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে গোটা এলাকা।
দীপাবলি উৎসবকে ঘিরে প্রতি বছরের মতো কালিবাড়ি সংলগ্ন নিজমেহার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মাসব্যাপী মেলা বসেছে, যা স্থানীয়ভাবে “কালিবাড়ি মেলা” নামে পরিচিত। মেলায় শিশুদের টমটম গাড়ি, নানা রঙের পুতুল, বেলুন থেকে শুরু করে খেলনার ড্রোন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি পাহাড়ি অঞ্চল থেকে আসা খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, সোফা সেট, ডাইনিং টেবিল, ডিভানসহ নানা আসবাবপত্র রয়েছে।
এ ছাড়াও রয়েছে দৈনন্দিন ব্যবহার্য কাঠ-বাঁশ-বেতের তৈরি আসবাবপত্র ও মাছ ধরার সরঞ্জাম। গৃহস্থালি সামগ্রীর মধ্যে হাড়ি, পিড়ি, মালসা, জলচৌকি, ব্লেন্ডার, প্রেশার কুকার, ইলেকট্রিক কেটলি থেকে ইনডাকশন চুলা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে।
দা, খন্তা, কুড়াল, কাস্তে, মাটির ব্যাংক, কাসা ও স্টিল এবং কাঁচের তৈজসপত্রসহ নানা ধরনের জিনিসও পাওয়া যাচ্ছে মেলায়। এছাড়া চটপটি-ফুচকা, তিলা, কদমা, নিমকি প্রভৃতি হরেক রকমের খাবারও সাজানো রয়েছে দোকানজুড়ে।
পূজা দিতে আসা নোয়াখালীর সুবল দাস বলেন, “শক্তিরূপিণী মঙ্গলময়ী দেবী কালীর পূজা দিতে আমি প্রতিবছর সপরিবারে এখানে আসি।”
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের অমিয় চক্রবর্তী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় থেকে আগত লিটন সূত্রধর জানান, “এটি সিদ্ধ পীঠস্থান, যা বাংলাদেশে অদ্বিতীয়।”
কালিবাড়ির বাসিন্দা ও শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক স্বপন কর্মকার মিঠুন বলেন, প্রায় সাত শ’ বছর আগে ঠাকুর সর্বানন্দ শবদেহের উপর বসে কালী মাতার সাধন করেন এবং পৌষ সংক্রান্তির তিথিতে মাতাকে দশ রূপে দর্শন লাভ করেন। এজন্য এ স্থানটি দশ মহাবিদ্যা সিদ্ধ পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত। এখানে মা কালির কোনো মূর্তি নেই; ভক্তরা জিন বৃক্ষের বেদিতে পূজা দেন।
শ্রী শ্রী মেহের কালিবাড়ি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি নিখিল মজুমদার বলেন, তিন শত বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এখানকার মাসব্যাপী মেলা ধর্মীয় আচারের পাশাপাশি প্রাচীন লোকজ ঐতিহ্য বহন করে আসছে।