চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “মেহার উচ্চ বিদ্যালয়” এখন নানান অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তছরুপসহ এমপিও নীতিমালা-২০২১ লঙ্ঘন করে পরিচালনা কমিটির মর্জিমাফিক কার্যক্রম পরিচালনার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অনিয়মের সত্যতা মিললেও, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা বহাল তবিয়তে আছেন। ফলে প্রতিষ্ঠানটির সামগ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
প্রধান শিক্ষক ও কমিটির বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগের অনুসন্ধানে জানা যায়, এমপিওভুক্ত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ও প্রধান শিক্ষক হাজিরা খাতায় শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নামের ক্রম নির্ধারণের নীতিমালা মানেননি। কোনো নিয়ম না মেনে বেসরকারি অংশের শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে, যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রেজুলেশন নেই। বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে শিক্ষকরা যে টাকা পেয়েছেন, তা নিয়ে অনেকের অসন্তোষ রয়েছে।
অভিযোগকারী শিক্ষক গোলাম সরওয়ারসহ বেশিরভাগ শিক্ষক দাবি করেছেন যে তাদের বেতন থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডে যা জমা দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে কম টাকা তারা উত্তোলন করেছেন।
অফিসের পক্ষ থেকে নিয়মিত ফান্ডে টাকা জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি, যার কোনো ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা প্রমাণ প্রধান শিক্ষক বা ভুক্তভোগী শিক্ষকরা দেখাতে পারেননি। প্রধান শিক্ষকের তথ্যমতে, এপ্রিল ২০১৭ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত জমাকৃত টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা গেছে। একই সময়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক গোলাম সরওয়ার ও মোতালেব হোসেন ৮ হাজার টাকা পেলেও পান্না রাণী দত্ত নামে আরেক শিক্ষক পেয়েছেন ১৫ হাজার টাকা।
বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মিজানুর রহমানের ভাষ্যমতে, বিশেষ কাজে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা খরচ করা হয়েছে, যা তদন্ত প্রতিবেদনেও অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে অগ্রণী ব্যাংক শাহরাস্তি শাখায় শিক্ষক প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী ও গোলাম সরওয়ারের নামে একটি হিসাব খোলা হলেও বর্তমানে তা সচল নেই এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য কোনো ভবিষ্যৎ তহবিল চালু নেই।
এমপিও নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী সিনিয়র শিক্ষক মো. গোলাম সরওয়ার উচ্চতর স্কেলে দশম গ্রেড থেকে নবম গ্রেডে উন্নীত হলেও, তাঁকে হাজিরা খাতা ও বিদ্যালয় অংশের বেতন খাতায় জুনিয়র শিক্ষকদের তালিকায় রেখে বেতন ও অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল বিদ্যালয়ে যোগদানের পরও দীর্ঘ পাঁচ বছর প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা জমা দিয়েও তিনি তার ন্যায্য পাওনা বুঝে পাননি।এদিকে ২০১৮ সালে যোগদান করা বর্তমান প্রধান শিক্ষক সনজিত কুমার সরকারের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের পাশাপাশি ফলাফল বিপর্যয়েরও অভিযোগ উঠেছে। তার দায়িত্বকালে ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ১০২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৩১ জন পাস করেছে এবং ৭১ জন অকৃতকার্য হয়েছে, যা স্কুলের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল বলে অভিভাবকরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, যোগদানের পর তিনি হাজিরা খাতায় পদমর্যাদা অনুযায়ী শিক্ষকদের সিরিয়াল ঠিক করেননি, কোনো কোনো শিক্ষককে স্কেল অনুযায়ী স্কুল অংশের বেতন দেওয়া হয়নি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের জমাকৃত টাকা কম দেওয়া ও ফান্ড বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি, সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী অর্থ কমিটি না করে স্বজনপ্রীতি ও মর্জিমাফিক বিদ্যালয় পরিচালনা, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া এবং মাসিক মাসোহারার বিনিময়ে বিদ্যালয়ের পাশেই প্রাইভেট পড়ানোর ‘অনুমতি’ দেওয়ার মতো অসংখ্য অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। পূর্বে শাহরাস্তির পঞ্চগ্রাম আজিজুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক থাকাকালেও তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের হেনস্থার অভিযোগ উঠেছিল।
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক সনজিত কুমার সরকার ‘শেয়ার বিজ’কে জানান, তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সত্যতা নেই এবং তিনি পরিচালনা কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই কাজ করেছেন। তবে জেলা শিক্ষা অফিসের তদন্ত রিপোর্টে তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি এখনো বহাল তবিয়তে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজিয়া হোসেন প্রথমে বিষয়টি অবগত নন জানালেও, পরবর্তীতে তদন্ত রিপোর্ট ও নথি দেখে তিনি ‘বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বলে জানান।অন্যদিকে, শাহরাস্তি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আলী আশ্রাফ খান এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে শালারপুত গণমাধ্যমকে জানান এবং জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানার পরামর্শ দেন।