এটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। ট্রেনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপে সন্তানকে বুকে নিয়ে মাসহ সন্তানের মর্মান্তিক মৃত্যু। বিষয়টি সবার বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এমন দূর্বৃত্তায়ন দেশের মানুষ আর দেখতে চাইনা।
আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের তিনটি বগিতে আগুনের ঘটনায় মা ও শিশুসন্তানসহ চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আগুনে ‘ছ, জ ও ঝ’ এসি কোচ পুড়ে গেছে। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ছেড়ে আসার পথে কোথাও এ অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের মর্গের সামনে অপেক্ষমান স্ত্রী-সন্তান হারানো মিজানুর রহমান বলেন, আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাইছি কিন্তু পারছি না। আমার ভেতরে কী চলছে এটা বোঝাতে পারব না। আমার তো সবই শেষ হয়ে গেল। কী অপরাধে আমার সব শেষ হয়ে গেল জানি না। আমি কারও কাছে বিচার চাইব না। এখন একটাই চাওয়া আমার স্ত্রী-সন্তানকে যেন আর কাটা-ছেড়া করা না হয়। শুধু অক্ষত লাশ ফেরত চাই।
মঙ্গলবার ভোর ৫টায় ট্রেনে আগুনের সংবাদ পায় ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় ট্রেনের ভেতরে আটকা পড়ে পুড়ে মারা যান মিজানুর রহমানের স্ত্রী নাদিরা আক্তার (৩২) ও তাদের তিন বছরের ছেলে ইয়াছিন রহমান। ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে তাদের লাশ। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে শোকে কাতর মিজানুর।
রাজধানীর পশ্চিম তেজতুরীবাজার এলাকায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন মিজানুর। তেজগাঁও এলাকায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসা রয়েছে তার। বড় ছেলে রিয়াদ হাসান ফাহিম স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর গত ৩ ডিসেম্বর দুই সন্তান নিয়ে তার স্ত্রী নাদিরা আক্তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় যান। সেখান থেকেই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে করে ঢাকায় ফিরছিলেন তার স্ত্রী ও দুই সন্তান।
নাদিরার ছোট ভাই হাবিবুর রহমানও দুর্ঘটনার সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন। ট্রেনে আগুন লাগার পর ফাহিমকে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যান হাবিবুর। তবে নাদিরা ও ইয়াছিন আটকা পড়েন।
মিজানুর জানান, সোমবার রাতেও স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছিল তার।
তিনি বলেন, আজ ভোর ৫টার দিকে নাদিরার ভাই হাবিবুর ফোন করে আগুন লাগার খবর দেন। বাসা থেকে দ্রুত তেজগাঁও রেলস্টেশনে পৌঁছান তিনি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন চারটি লাশ নামায়, দেখি আমার স্ত্রী-সন্তান পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।
জানা গেছে, নেত্রকোনা সদরের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন একই পরিবারের সদস্য ও স্বজনসহ ৯ জন। সোমবার রাতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে ওঠেন তারা। বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে যান তাদের পাঁচজন। এরপর ট্রেন চলতে শুরু করলে হঠাৎ ধোঁয়ায় ভরে যায় কামরা। ‘আগুন আগুন’ বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়। তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন থামতে সবাই হুড়োহুড়ি করে নেমে যান। শুধু চার হতভাগ্য নামতে পারেননি। তাদের মধ্যে ছিলেন নাদিরা আক্তার ও তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন। আগুনে পুড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তাদের।
নাদিরার দেবর প্রকৌশলী মিনহাজুর রহমান বলেন, ভাবির কোলে ছিল ছোট্ট ইয়াছিন। বাচ্চা নিয়ে উনি আর নামতে পারেননি। আগুন নেভানোর পর ওনার লাশ উদ্ধার করা হয়। তখনো তার কোলে ছিল সন্তানের লাশ। দুজন একসঙ্গে পুড়ে মারা গেছেন।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন যাত্রীদের বরাত দিয়ে জানান, ট্রেনটি নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় আসছিল। বিমানবন্দর স্টেশন পার হওয়ার পর যাত্রীরা পেছনের বগিতে আগুন দেখতে পান। পরে তারা চিৎকার করতে শুরু করেন। এরপর চালক ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে থামান।
তেজগাঁও রেলস্টেশনের সহকারী স্টেশনমাস্টার এসএম পর্বত আলী বলেন, ভোর ৪টা ৫৮ মিনিটে ট্রেন তেজগাঁও আসে। ৬টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ছেড়ে আসার পথে কোথাও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এখানে ট্রেনটি থামার কথা ছিল না। তবে আগুন দেখে ‘সিগন্যাল ডেনজার’ দিয়ে ট্রেন থামানো হয়। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। আগুনে ‘ছ, জ ও ঝ’ কোচ পুড়ে গেছে। তিনটিই এসি কোচ। ট্রেনটি তেজগাঁও রেলস্টেশন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন জানান, ট্রেনের দুই কোচের মাঝের স্থানে প্রথমে আগুন দেখতে পান রেলকর্মীরা। ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালানো হয়। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বরং পাশের কোচগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তারা দ্রুত নামার চেষ্টা করেন। তবে যাত্রীদের কেউ কেউ বিষয়টি বুঝতে পারেননি। তাদের কয়েকজন হতাহত হয়েছেন। এটি রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে নাশকতা বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।